পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় পাঁচ পদক্ষেপ জরুরী
শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে ‘আস্থা ফেরাতে’ ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকে পাঁচ পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এসব ইস্যু নিয়ে কাজ করলে পুঁজিবাজার দ্রুত স্থিতিশীল হবে। নতুন নতুন বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হবে। তাহলে পুঁজিবাজারে দ্রুত লেনদেন বাড়বে। একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকমের টিমের কাছে বাজার স্থিতিশীলতার ইস্যুর বিষয়ে উল্লেখ্য করেন।
ইস্যুগুলোর মধ্যে-বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে আইপিও অনুমোদন না দেয়া, কোম্পানির স্পন্সরদের শেয়ার বিক্রি বন্ধ রাখা, বাজারে নতুন ফান্ড আনা বা দ্রুত লেনদেন বাড়ানো, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করা, বাইব্যাক আইন চূড়ান্ত করা।
এছাড়া পুঁজিবাজারে গতি ফিরিয়ে আনতে হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কারন বিনিয়োগকারীরা বহুবার বিনিয়োগ করে লোকসানের শিকার হয়েছেন। এবার যেন তাদের সেপথে যেতে না হয়। দেশের পুঁজিবাজারে পুরোপুরি স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালের বড় ধসের পর শেয়ারবাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল।
তখনকার সময়ে পুঁজি হারানো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে শেয়ারবাজার ছিল বড় আতঙ্কের নাম। ১৯৯৬ সালে পুঁজি হারানো এসব সাধারণ বিনিয়োগকারী তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেই নতুন করে শেয়ারবাজারে অর্থ লগ্নি এখন হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ১৫ বছর পর বিষয়টি ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে। ২০১০ সালে ফের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের বিপর্যয়ের পর আগের সেই ঘটনার সঙ্গে তুলনা চলছে নানাভাবে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পক্ষ থেকে একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাস্তবে তা শেয়ারবাজারের কোনো কাজে আসেনি। ফলে দিনের পর দিন শেয়ার মূল্যের ওঠানামা বিনিয়োগকারীদের বিপর্যস্ত করেছে।
এবং এর ফলে সাধারণ তথা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুঁজিবাজারের ওপর থেকে একরকম উঠেই গেছে। বিনিয়োগকারীদের একটি প্রধান অংশই শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত মুনাফার টাকা লোকসান দেওয়ার পর মূলধনের বড় অংশ হারিয়ে ফেলেছে।
সাম্প্রতিক স্মরনকালের দরপতনের পর থেকে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য প্রায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর ফলে পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৯ সালের শুরু থেকে বিভিন্ন খাত থেকে স্রোতের মতো টাকা প্রবেশ করলেও, সঠিক সময়ে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন শেয়ারের জোগান বাড়াতে না পারার কারণেই পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক আকাশচুম্বী প্রবণতা তৈরি হয়।
অধিকাংশ তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দাম কয়েক বছরের মধ্যেই শীর্ষে পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েও বাজারের রাশ টানতে ব্যর্থ হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সেই সঙ্গে তারল্য সংকট নামক আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বাজারকে আতঙ্কে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের বাজার থেকে মুনাফা তুলে নেওয়া এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন মহলের অপতৎপরতা, সরকারের উদাসীনতা নামক পক্ষসমূহ শেষ পর্যন্ত সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে পুঁজিবাজার নামক কফিনে।
কিন্তু এসব কৃত্রিমতা বাজারকে কখনোই সচল রাখতে পারবে না, কারণ দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনাসমূহ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপসমূহ সুদৃঢ় হবে না। তাই এ অবস্থায় শেয়ারের দাম বাড়াতে হলে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি এই মুহূর্তে, তা হলো শেয়ারের কার্যকর চাহিদা বাড়ানো।
এটা করতে হলে শেয়ারবাজারে তারল্য বাড়াতে হবে এবং এ জন্য বিনিয়োগকারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মার্জিন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুঁজিবাজারকে উৎপাদনশীল খাতে মূলধন জোগান দেওয়ার অন্যতম উৎস হিসেবে গড়ে তুলে জাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংককেও সক্রিয় হতে হবে। গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক পদক্ষেপই পুঁজিবাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার থেকে যে অর্থ তুলে নিয়েছে, আইনি সীমার মধ্যে তার একটি অংশ আবার বিনিয়োগ শুরু করলে বাজারে গতিশীলতা নিশ্চিত হবে। শেয়ারবাজারে চাহিদা তৈরি করতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা, তাই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তৎপরতা বাড়ালে বাজারে চাঙা ভাব ফিরে আসবে।
এতে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়ে লেনদেনে সক্রিয় হবেন। বিনিয়োগকারীদের আরও সচেতন হতে হবে, বাজার বিশ্লেষণ করতে হবে নিজস্ব মেধা দ্বারা, অন্যের সিদ্ধান্তে প্রভাবিত না হয়ে এবং মনে রাখতে হবে যে গুজবে কান দেওয়া যাবে না।
পাশাপাশি এই বাজার থেকে অনিয়ম দূর করতে হবে, যেমন শেয়ারের দাম হ্রাস পেলে যে রকম নজরদারি করা হয়, তদ্রূপ শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
আইপিও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা আনতে নিয়ম তৈরি করতে হবে, স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে শেয়ারের দর নির্ধারণে কমিটি গঠন, বাইব্যাক আইন চূড়ান্ত করা, ডিমিউচুয়ালাইজেশন অব স্টক এক্সচেঞ্জ, রাইট শেয়ার বিধিমালায় পরিবর্তন, প্লেসমেন্ট সম্পর্কে আইন প্রণয়ন, ফোর্স সেলিং বন্ধ করা, অমনিবাস হিসাবে নজরদারি বৃদ্ধি করা।
প্রয়োজনে সিএফএ (চার্টার্ড ফাইন্যান্স এনালাইসিস্ট) ডিগ্রি অর্জনকারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটিকে তিনটি ভাগে সাজিয়ে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে এভাবে, একটি দল শুধু দেশের দুটি প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এনালাইসিস ও মনিটরিং করবে। আরেকটি দল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্রোকার হাউসগুলো মনিটরিং করতে পারে।
সর্বশেষ দলটি বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্য একটি ইনস্টিটিউটের মতো কাজ করতে পারে, যেখানে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ হবে বাধ্যতামূলক।
উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশ শেয়ারবাজারের সঙ্গে ফাইনানসিয়াল ডেরিভেটিভ ইনস্ট্রুমেন্টের পরিচয় ঘটাতে হবে, যা কিনা শেয়ার দরের অস্বাভাবিক ওঠানামা রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
সর্বোপরি দেশের পুঁজিবাজারে বাধ্যতামূলকভাবে ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনে যেসব বিনিয়োগকারী লোকসানে রয়েছেন, তাঁদের উচিত হবে সঠিকভাবে পোর্টফোলিও বিন্যস্ত করা এবং একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে ক্ষুদ্র মূলধনের কোম্পানির দাম যেমন দ্রুত বাড়ে, ঠিক তেমনি দ্রুত কমে।
অতএব, শেয়ারবাজারের দুর্দশা কাটানোর জন্য দরকার এর ইমেজটা ফিরিয়ে আনা। পুঁজিবাজার কোনো ফাটকা বাজার বা জুয়া খেলার স্থান না, এটি দেশের অর্থনীতিরই অংশ। শেয়ারব্যবসা থেকে লাভ করা মানেই দুষ্টচক্রের অংশ, জনমনে এমন ধারণা ঠিক নয়। এই পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে, মৌলভিত্তি দেখে, আস্থার সঙ্গে বিনিয়োগ করা।