দুই ইস্যুতে আটকে আছে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা!
আমীনুল ইসলাম, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের দুই পুঁজিবাজারে একদিকে রয়েছে তারল্যের সঙ্কট অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। বাজার উন্নয়নে সকারের নেওয়া নানা উদ্যোগও কাজে আসছে না। ফলে দীর্ঘ দিন পুঁজিবাজারে চলছে অস্থিরতা। আর বর্তমান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট ও তারল্য সংকটের কারনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না। বর্তমান বাজার নিয়ে সরকারসহ নীতি নির্ধারকরা বাজার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং আজ ভাল তো কাল খারাপ।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বিনিয়োগ করতে পারছে না পুঁজিবাজারে। ফলে অর্থ সঙ্কটে ভুগছে শেয়ারবাজার। এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকে একক গ্রাহক ঋণ সমন্বয়ের সময় (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) দুই বছর বাড়ানোর কথা বললেও তা আশ্বাসেই ঝুলে রয়েছে। যার কারণে অনেকটা নিষ্ক্রিয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিযোগকারীরা। ফলে হোঁচট খাচ্ছে পুঁজিবাজার।
অন্যদিকে ধস পরবর্তী বাজার রক্ষায় নীতিনির্ধারক মহল থেকে অসংখ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখেনি। আর সফলতা না আসার কারণেই পতনের বৃত্ত থেকে বাজারকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। মূলত একশ্রেণীর বিনিয়োগকারীর স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগের কারণেই আস্থার অভাব বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, একশ্রেণীর স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারী আছে যারা বারবার উর্ধমুখী বাজারের সুবিধা নিয়েছে। আবার সুযোগ বুঝে শেয়ার বিক্রি করে নিস্ক্রিয়ও হয়ে গেছে। এ ধরনের স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের কারনেই বাজারে স্বাভাবকি আচরণ স্থায়ী হচ্ছে না। পাশাপাশি তারল্য সংকটের কারনে বাজার সোজা হয়ে দাঁড়াতো পারছে না।
আর যেহেতু বাজার স্বাভাবিক না হলেও তাদের মুনাফায় ঘাটতি পড়ছে না তাই ইচ্ছে করেই তারা বাজারকে নিম্নমুখী প্রবণতায় রাখতে চাচ্ছে। আর এতে করে বাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বারবার চিড় ধরেছে।
এ পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘ ছয় বছর অতিক্রম করেছে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ ৬ বছর একটি স্থিতিশীল বাজার দেখার অপেক্ষা থাকলেও তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। এ পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘ ৬ বছর অতিবাহিত করেছে বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে ২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে কয়েকবার বাজারে উত্থান প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এর এ উত্থান প্রবণতা দেখে বিনিয়োগকারীরা প্রতিবারই লোকসান কাটনোর প্রত্যাশা করেছেন। অনেকে নতুন করে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের লোকসান কাটানোর চেষ্টাও করেছেন; কিন্তু কিছুদিন বাজার স্থিতিশীলতার আভাষ দিয়ে হঠাৎ করেই আবার পতনে রুপ নিয়েছে।
সে সময় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমান আরো বেড়েছে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে পুঁজির পাশাপাশি কমেছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা। যা বর্তমানে তলানীতে এসে ঠেকেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এমন সঙ্কটে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও।
বারবার আহ্বান করা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে সক্রিয় হচ্ছে না প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। তাদের নিস্ক্রিয়তার কারণে বাড়ছে না লেনদেনের পরিমান। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা বাড়ছে। অপরদিকে তারল্য সঙ্কট নয় ধারাবাহিক দরপতনের কারনেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এমন কথা বলছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আর বাজার স্থিতিশীল না হলে নতুন করে বিনিয়োগের ঝুঁকিতে যেতে চাইছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট আর আস্থাহীনতার কারনে দৈনিক লেনদেনের পরিমান নেমে এসেছে ৩’শ কোটি টাকার নিচে। যেখানে দৈনিক ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে হতে দেখা গেছে সে তুলনায় এখনাকার লেনদেন অনেক কম।
আর ধারাবহিকভাবে লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিস্ক্রিয়তাকে দায়ী করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সংকটের সময় পুঁজিবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন মহল থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সেগুলো আর বাস্তবায়ন করা হয় না।
বারবার এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান বাজার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা সংকট কাটলে হলে বাজার টানা স্থিতিশীল থাকতে হবে। তেমনি লেনদেনের পরিমান দ্রুত বাড়তে হবে।
বাজার বিশ্লেষনে দেখা যায়, ৫ কার্যদিবস পর ফের বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আর্থিক লেনদেন ৪০০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে। বুধবার চলতি সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ৩৯০ কোটি টাকা। মঙ্গলবারের তুলনায় লেনদেন কম হয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। মঙ্গলবার লেনদেন হয়েছিল ৪৭৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর আগে ৫ এপ্রিল ৪০০ কোটি টাকার নিচে ৩১৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলা নববর্ষ ও সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে টানা ৩ দিনের ছুটি। এ সুযোগে অনেক বিনিয়োগকারী গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কম থাকায় লেনদেনে প্রভাব পড়েছে।
এদিকে দিনভর সূচকের উত্থান-পতন শেষে মূল্য সূচকের সামান্য উন্নতিতে শেষ হয়েছে দিনের লেনদেন। দিনশেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) বেড়েছে ১.১১ পয়েন্ট। এর ফলে ডিএসইর এ সূচকটি ৪৪০৮.৬৪ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলছেন, দীর্ঘ ৬ বছর অপেক্ষা করেও আমরা একটি ভালো বাজার পেলাম না। বিভিন্ন পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে ঢাক ঢোল বাজিয়ে বাজার উন্নয়নের কথা বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যার কারণে ঘুরে ফিরে বাজার সেই পতনের বৃত্তেই হাঁটছে। আর এতে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন বিনিয়োগকারী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক সাবেক পরিচালক বলেন, বাজারে বিনিয়োগকারীদের পদচারণা কেমন তা বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাজারের লেনদেন। লেনদেনবিহীন পুঁজিবাজার একটি মৃত বাজারের শামিল। টাকার অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে আমরা যদি বাজারে বর্তমান শেয়ার সংখ্যার দিকেও লক্ষ করি তাহলে এই বাজার ন্যূনতম ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হওয়া উচিত।
অথচ আমদের বাজার ৫০০ কোটি টাকার ওপরেই উঠতে পারে না। মাঝে মাঝে তো ২৫০ থেকে ৩০০ কোটিতে লেনদেন হয়। এই অবস্থায় যদি পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে পুঁজিবাজারে আস্থার কোনো সংকট নেই; তাহলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) এক নেতা বলেন, বাজারকে স্থিতিশীল করার লক্ষে গত ছয় বছরে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কোনো কাজে আসেনি। মুলত: আস্থাসংকটও তারল্য সংকটের কারনেই বিনিয়োগকারীরা এখানো বাজারে আগের মত সক্রিয় হতে পারছেন না।
বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগেরই এখন বিনিয়োগের ক্ষমতা নেই; আর যারা বিনিয়োগ করতে পারবেন তারা বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছেন। কেউ শেয়ার কিনে বিক্রি করতে পারবে কিনা, নাকি দরপতনে তাদের আরো লোকসান হবে এমন সন্দেহে অনেকেই শেয়ার কেনা থেকে বিরত রয়েছেন।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা ব্যাপক। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাজারের চেহারা বদলে দিতে পারে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই তারা স্বাভাবিক বাজারের প্রত্যাশা করবে।
বর্তমান বাজারে যার অভাব রয়েছে। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও আস্থা সংকটে ভুগছে। যে কোনো মূল্যে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। বাজার স্থিতিশীল হলে তা এমনিতেই তৈরি হবে।