sharebazer lagoআমিনুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে লেনদেনে অস্থিরতা সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। বর্তমান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল তেমনি ইতিবাচক অর্থনীতির ঊর্ধ্বগতি হলেও ঘুরে ফিরে পতনের বৃত্তেই রয়েছে পুঁজিবাজার।

বাজার আজ ভাল তে কাল খারাপ এ প্রশ্ন খোদ বিনিয়োগকারীদের। কেন পুঁজিবাজার এমন অবস্থা? এ প্রশ্ন খুজতে শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকমের একটি টিম দ্বারস্থ হচ্ছে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের কাছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটছে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।  এমন পরিস্থিতিতে বাজারের লেনদেনে স্বাভাবিকতা ফিরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের পরও স্বস্তি ফিরছে না বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট মহলে।

তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তির কিছুটা বিরাজ করলে বাজারের প্রতি পুরোপুরো আস্থা বাড়ছে না। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন পুঁজিবাজার নিয়ে ভাবার কেউ নেই। দেশে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী অধাহারে অনাহারে জীবনযাপন করলে এদের দেখার কেউ নেই।

পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ (ওভার এক্সপোজার) সমন্বয়কে পুঁজিবাজার ধসের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাই নানা সময়ে ব্যাংকগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর বিনিয়োগকারীরা ক্ষুব্ধ।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অভিযোগ করেছেন, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা আরও কয়েক বছর থাকার ব্যাপারে তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তা উপেক্ষা করে সময়সীমা এক বছরে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এতে শেয়ারবাজারে দরপতন ত্বরান্বিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শেয়ার বিনিয়োগকারীরা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সক্ষমতা কমে গেছে। ফলে তাদের বাড়তি বিনিয়োগের পরিমাণও বেড়ে গেছে। এ বাড়তি বিনিয়োগ ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে সমন্বয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি করতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করতে হবে। কিন্তু মন্দা বাজারে এ শেয়ার বিক্রি করা হলে তার চাপে বাজারে শেয়ারের দাম অনেক কমে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় অনেক বিনিয়োগকারী হাত গুটিয়ে বসে আছে। এতে বাজার মন্দার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একসময় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসীভাবে শেয়ার ক্রয়ের কারণেই শেয়ারবাজার হঠাত্ করে চাঙ্গা হয়ে উঠে। আর বাজার চাঙ্গা হওয়ার পর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারে ঝুঁকেছেন।

ব্যাংকগুলো যখন আগ্রাসীভাবে শেয়ার ক্রয় করেছে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের থামাতে পারেনি। অথচ বাজারে উচ্চ দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার পর ব্যাংকের বিনিয়োগ কমানোর ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে আসার সময়ই যদি তাদেরকে বাধা দেয়া হতো তাহলে শেয়ারবাজারের এ পরিস্থিতি হতো না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সীমার বাইরে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর পর্যাপ্ত পরিমাণ শেয়ার বাজারে না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের মতে, বাজারে মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বহুজাতিক বা বহুজাতিক মালিকানাধীন। কিন্তু কোম্পানিগুলো শেয়ারের চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীদের অসম্পৃক্ততা, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফার সংকট, দেশীয় কোম্পানিগুলোর মুনাফার অপ্রতুলতা ও আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিকে লোকসানি করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা।  এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের পাশাপাশি প্রয়োজন বাজার উন্নয়নে যুগোপযোগী পদক্ষেপ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সিকিরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, শুধু গভর্নরের পদত্যাগের মাধ্যমেই পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরানো সম্ভব নয়। কেননা, পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে কাজ করছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। আর বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট কাটাতে ব্যাংক এক্সপ্লোজার লিমিটের সময় কমপক্ষে ২০২১ সাল কিংবা তার বেশি সময়ের জন্য বর্ধিত করা জরুরি।

ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াকার এ চৌধুরি জানান, পুঁজিবাজারে ব্যাপক তারল্য সংকট রয়েছে। যা নিরসন করতে পারলে বাজারের লেনদেনে গতি ফিরবে। সরকারের হাতে এখন প্রচুর লিকুইড মানি (তারল্য) রয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বাজারের তারল্যের জোগান দিতে পারে। এতে করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট কমবে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিশোদের সভাপতি মিজান-উর রশীদ চৌধুরি বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের পাশাপাশি আরো অনেকেই দায়ী। তিনি বলেন, গভর্নর পদত্যাগ করলেই পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে না। টানা প্রাথমিক গণ প্রস্তাব অনুমোদন ও রাইট শেয়ার অনুমোদনের মাধ্যমে বাজারকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। এজন্য এ সংস্থার প্রদানেরও পদত্যাগ করা উচিত।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের শেষদিকে শেয়ারবাজারে ধস শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাজারে কোনো আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি দেখা দেয়নি।