ব্যাংকের এক্সপোজারের লিমিট ২০২০ সাল করার দাবী
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০২০ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাজার সংশ্লিষ্ট সহ শীর্ষ সিকিউরিটিজগুলো। এছাড়া বাজারের চলমান পতন ঠেকাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ ক্যাপিটালের ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০২০ পর্যন্ত বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনক (বিএসইসি), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ ২০টি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজ। এর পর থেকে নড়ে চড়ে বসছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
পুঁজিবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময় বাড়ানোর জন্য তৎপর হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। স্বল্প সময়ে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারকে কেন্দ্র করে বাজারের টানা পতন রোধে এ উদ্যোগ নিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে শেয়ারে বিনিয়োগ সমন্বয়ে ব্যাংকগুলোকে আরো সময় দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন।
এদিকে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের অনাদায়ী লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে বিএসইসি। এছাড়া মার্জিন রুলস, ১৯৯৯-এর ৩(৫) উপধারা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়েও সম্মতি জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, গত গত ৪ নভেম্বর এ ২০ প্রতিষ্ঠান বিএসইসি, ডিএসই এবং সিএসই’র কাছে চিঠি দেয়। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ ২০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেযোগ্য হলো, লঙ্কা-বাংলা সিকিউরিটিজ, ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজ, এনসিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজ এন্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, এনবিএল সিকিউরিটিজ, ইবিএল সিকিউরিটিজ, ইউসিবিএল সিকিউরিটিজ, ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজ এবং পূবালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ। ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট, ২০১৩ এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ২১ জুলাই, ২০১৬ এর মধ্যে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ ক্যাপিটালের ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ ক্যাপিটালের ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে ব্যাংকগুলোকে ৬-৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করতে হবে। যা বাজারের বর্তমান মন্দা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। আর এমন অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এবং পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একান্ত সহযোগীতা প্রয়োজন। তাই এ মন্দাবস্থা থেকে বেরোতে হলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের সময়সীমা ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে এমটিবি সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী নজরুল ইসলাম মজুমদার জানান, যারা ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিকিউরিটিজ ব্যবসা করছে, তাদের পক্ষে ২০১৬ সালের মধ্যে পুঁজিবাজার বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে গেলে পোর্টফোলিওতে থাকা বিপুল পরিমাণ শেয়ার বেচে দিতে হবে। এতে করে বাজারে সেল প্রেসার তৈরি হবে যা বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে। আমাদের ব্যবসা পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট হওয়ার ফলে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তাই পুঁজিবাজার, সিকিউরিটিজ হাউজ এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আমরা পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ২০২০ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী জানান, ‘২০১০ সালে যখন ব্যাংকগুলো নিয়মের তোয়াক্কা না করে পুঁজিবাজারে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করেছে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। তারপরে হুট করে নির্দেশনা জারি করে ব্যাংকগুলোকে তাদের বিনিয়োগ কমানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছি। যার কারণে বাজারে অস্বাভাবিক সেল প্রেসার তৈরি হয় এবং বাজারে মহাধস নামে। তারপর থেকেই পুঁজিবাজারের অবস্থা অনেকটা নিম্নমুখী অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এর পরে ব্যাংকের সময়সীমা বেশ কয়েকদফা দুই-এক বছর করে বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল সমস্যার সমাধান তো হয়নি বরং সমস্য আরো দীর্ঘায়িত হয়েছে। এখন আবার নতুন করে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে মধ্যে বিনিয়োগ সমন্বয়ের খড়গ ঝুলছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক ব্যবসার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তাছাড়া এ সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ সমন্বয় করতে হলে আবারো বাজারে সেল প্রেসার তৈরি হবে যা বাজারে আবারো বড় ধরনের ধস নামার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে চলে যাবে। যা দেশের পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাবে। তাই এখন সুনির্দিষ্ট করে ২০২০ সাল পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ব্যাংকে বিনিয়োগ সমন্বয়ের সুযোগ দেয়া হলে প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই ব্যবসা করতে পারবে এবং ব্যবসায় বিসৃÍতর জন্য মূলধন বাড়ানোরও সুযোগ পাবে। আর তাতে করে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে যে অতিরিক্ত বিনিয়োগ রয়েছে সেটা এমনিতেই নির্ধারিত সীমার মধ্যে চলে আসবে। তাই এ বিষয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই, সিএসই এবং সর্বোপরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়াটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, পুঁজিবাজারে চলমান মন্দাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমরা বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছি। এর মধ্যে ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের সময়সীমা ২০২০ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাবে জোর দেয়া হয়েছে। এ প্রস্তাব মেনে নেয়া হলে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে বলে আমরা আসা করি।
এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ে সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের দাবির বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের চেয়ারম্যানের আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রী ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা-সংক্রান্ত বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে বলেছেন। এছাড়া বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের অনাদায়ী লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের মেয়াদ ও মার্জিন রুলস, ১৯৯৯-এর ৩(৫) উপধারা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আগামী বছরের ২১ জুলাইয়ের মধ্যে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর ফলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করতে হবে। আর এ বিষয়কে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি-নিষেধ আরোপের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও সীমিত হয়ে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থার সংকট তৈরি হয়।
শহীদুল ইসলাম