পুঁজিবাজারে সম্পদ মূল্যের নিচে রয়েছে ২৭ ব্যাংক
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৭ ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এক সময়ের পুঁজিবাজারের জৌলুশ পূর্ণ ব্যাংকিং খাত এখনো ঘুঁরে দাড়াতে পারেনি। ২০১০ সালের ধ্বসের পর অন্যান্য খাতের বেশ উন্নতি হলেও ব্যাংকিং খাত পিছিয়ে পড়ছে।
বর্তমানে ২৭ ব্যাংকের শেয়ার দর নীট সম্পদ মূল্যের নীচে অবস্থান করছে। তবে আমদানী রপ্তানীর নেগেটিভ প্রভাব, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পুঁজিবাজার বিপর্যয়ে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়াই ব্যাংকিং খাতের এ পরিস্থিতির কারন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকিং খাতের দিকে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ আগের মত এখন আর নেই। নানা কারণে ক্রমেই এ খাতটি তার চিরায়ত রূপ হারিয়ে ফেলছে। বর্তমানে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে এ খাতের কোম্পানিগুলো সংকটময় সময় অতিক্রম করছে।
এছাড়া এ খাতের তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭ টির অর্থাৎ ৮০ শতাংশ ব্যাংকের শেয়ারদর সম্পদ মূল্যের (এনএভি) নিচে অবস্থান করছে। মূলত এ খাতের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে না পারাই এর মূল কারণ বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধসের আগে দেশের ব্যাংকিং খাত ব্যাপক মুনাফায় থাকলেও গত সাড়ে পাঁচ বছরে এ খাতের মুনাফা ক্রমশ কমেছে। ব্যাংকিং খাত বিনিয়োগকারীদের ভরসার অন্যতম স্থান হলেও এ খাতের কোম্পানিগুলো অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে।
তাই বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্ভরযোগ্য হলেও এ খাত থেকে আশানুরূপ মুনাফা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। যারা এর আগে এ খাতের শেয়ার অতিরিক্ত দরে কিনেছিলেন তারাও বড় অংকের লোকসানে রয়েছেন। পরিণতিতে বিনিয়োগকারীরা এ খাতের ওপর আস্থার সংকটে রয়েছেন।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ভয়াবহ ধসের আগে পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগের ফলে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক মুনাফা করেছে। সেই সময় ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে পুঁজিবাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ মেনে ব্যাংকগুলো একযোগে বিনিয়োগ সরিয়ে নিলে বাজারে ভয়াবহ ধস নেমে আসে।
এরপর থেকে ব্যাংকগুলো আর পুনরায় অতিরিক্ত বিনিয়োগে যায়নি। ফলে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক ধারা রয়েছে। যে কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণ করা শেয়ার থেকেও আগের মতো মুনাফা আসেনি। বরং ধারণ করা শেয়ারের মূল্য কমেছে, তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়েছে। তারা জানান, এমনিতেই এ খাতের নানা দুর্নীতি ও জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আগের মতো আস্থা রাখতে পারছেন না।
এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একাধিকবার অযাচিত হস্তক্ষেপ করায় এ খাত সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তারা আরো বলেন, ফান্ডামেন্টাল হিসেবে খ্যাত এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর ক্রমেই কমে সম্পদমূল্যের নিচে নেমে এসেছে।
এছাড়া বর্তমান বাজারে কারসাজি চক্রের কারসাজিতে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিণতিতে এ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর এতোই কমেছে যে, এখন বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে আস্থা পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে, গত দুই বছরে ব্যাংকগুলো লোকসান কাটিয়ে ওঠার পরও শেয়ারদরে তার খুব একটা প্রভাব পড়ছে না। এমনকি ভালো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেও ফল পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। আর তাতে শংশয় প্রকাশ করেছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ব্যাংকের শেয়ারের এ দরপতনের ফলে বাজারে চলছে চরম হতাশা। বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ বরাবরই ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগে অভ্যস্ত। অনেকেই মনে করতেন, বাজারে ধস নামলেও ব্যাংকিং খাতে তেমন প্রভাব পড়বে না।
কিন্তু তাদের সে ধারণায় আশার আলো জ্বলেনি। বরং একের পর এক দরপতনে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে ব্যাংকিং খাত থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই নয়,প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষককরা বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ না করার কারণে এ খাতটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের বিপরীতে তারা স্বল্প মেয়াদে ক্রয়-বিক্রয় করছে। তাদের এ ধরনের আচরণ অপেশাদার, যা পুঁজিবাজারের জন্য নেতিবাচক বলে মনে করছেন তারা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ মতে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ না করার কারণে এ খাতটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিরব ভূমিকা পালন করছে। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের বিপরীতে তারা স্বল্পমেয়াদে ক্রয়বিক্রয় করছে। তাদের এ ধরনের আচরণ ননপেশাদার। যা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক নয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সদস্য সাকিল রিজভি বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক খাতকে উত্তম। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগে অনীহা বিনিয়োগকারীদের। তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়ন স্বার্থেই সংশ্লিষ্টদের, এ খাতের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর ওপরে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
বাজার বিশ্লেষনে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাত কোম্পানি রয়েছে ৩০টি। এর মধ্যে সম্পদ মূল্যের (এনএভি) নিচে নেমে এসেছে ২৭টি ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার দর। ব্যাংকের শেয়ার দরের এমন পতনে হতাশ সংশ্লিষ্টরা। অক্টোবরে, ২০১০ সালে এবি ব্যাংক কোম্পানির প্রতি শেয়ার দর ছিল হাজার টাকার বেশি। এসময়ে প্রতি শেয়ারে ফেস ভ্যালু ছিল এক’শত টাকা। অবশ্য সেই এবি ব্যাংকের শেয়ার দর বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২২ টাকা। এসময়ে ফেস ভ্যালু প্রতি শেয়ারে হয়েছে ১০ টাকা। ফেস ভ্যালু ১০০ টাকার শেয়ার ফেস ভ্যালু যখন ১০ টাকা রুপান্তরিত হয়েছে।
তখন হাজার টাকা শেয়ার একশত টাকা হবার কথা ছিল। প্রকৃত পক্ষে সেই শেয়ারে বর্তমান অবস্থান রয়েছে তার চারগুন নিচে। এই হলো বর্তমান পুঁজিবাজারের অবস্থা। এই রকম দর কমেছে প্রায় প্রতিটি ব্যাংক কোম্পানির শেয়ারে। এই পাঁচ বছরে দর বাড়ে নাই। বরং সময়ের ব্যবধানে দর কমেছে অপ্রত্যাশিতভাবে।
তাঁরা আরও বলছেন, ৩০টি কোম্পানি মধ্যে সম্পদ মূল্যের (এনএভি) নিচে নেমে এসেছে ২৭টি ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার দর। এনএভির উপরে রয়েছে মাত্র ৩টি ব্যাংকের শেয়ার দর। এর মধ্যে তিনটি ব্যাংকের শেয়ারের দর ফেস ভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকের শেয়ার প্রতি অনীহার কারণে দরের বড় ধরনের ভাটা হয়েছে।
ডিএসইর তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর খাত হিসাবে মূল্য-আয় (পিই) অনুপাতে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। এ খাতের পিই হচ্ছে ৭.৭৭। এরপরই রয়েছে আর্থিক খাতের পিই। এ খাতের পিই হচ্ছে ৮.৭৫। সবচেয়ে বেশি পিই অনুপাত হচ্ছে পাট খাতের। এ খাতের পিই হচ্ছে ২০২।
সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, ২১ অক্টোবর বুধবার সম্পদমূল্যের তুলনায় দর কম কোম্পানিগুলো হল- এবি ব্যাংক সম্পদ মূল্য ৩৫.২৩ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২১.৮০ টাকা; আল-আরাফা সম্পদ মূল্য ১৭.৫১ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১২.৯০ টাকা; ইসলামী ব্যাংকে সম্পদ মূল্য ২৮.৯৩ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২৮.৬০টাকা; ব্যাংক এশিয়া সম্পদ মূল্য ২১.৭৬ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১৬.০০ টাকা; সিটি ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২৬.৭৪ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২০.১ টাকা; ঢাকা ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২২.৮২ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২০.৩০ টাকা; ইস্টার্ন ব্যাংক সম্পদ মূল্য ৩৩.১১ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২৮.১০ টাকা; এক্সিম ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৭.৯০ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৮.৮০ টাকা; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৬.৫৫ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৯.০০ টাকা;
যমুনা ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২০.৯৯ এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১১.৬০ টাকা: মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৮.২৮ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৯.৯০ টাকা; মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২২ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১৯.৭০ টাকা; ন্যাশনাল ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৭.২০ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১০ টাকা; এনসিসি ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৭.৮৮ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৯.১০ টাকা; ওয়ান ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৮.২৮ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১৩.৪০ টাকা; প্রিমিয়ার ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৫.৮৭ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৮.৮০ টাকা; প্রাইম ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২৩.৮৮ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১৯.৭০ টাকা।
পূবালী ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২৫.১৪ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২৩ টাকা; রূপালী ব্যাংক সম্পদ মূল্য ৭১.৪০ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৪৬.১০ টাকা; শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৫.৯৫ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১১.৭০ টাকা; সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৭.৩১ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১৩.১০ টাকা;
সাউথইস্ট ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২৬.৭৭ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১৬.৯০ টাকা; স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সম্পদ মূল্য ১৭.৩৪ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৯.১০ টাকা; ইউসিবিএল সম্পদ মূল্য ২৬.৯৩ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২১.৫০ টাকা; উত্তরা ব্যাংক সম্পদ মূল্য ৩০.৫৪ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২২.৫০ টাকা; আইএফআইসি সম্পদ মূল্য ২০.৮৪ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ২১.৭০ টাকা।
এছাড়া সম্পদমূল্যের তুলনায় দর বেশি ব্যাংক কোম্পানিগুলো হল- ব্র্যাক ব্যাংক সম্পদ মূল্য ২৭.১৬ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৪৭.২০ টাকা; ডাচ-বাংলা ব্যাংক সম্পদ মূল্য ৭২.৫৯ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ১০৪ টাকা; আইসিবি ইসলামী ব্যাংক সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক ১৪.৪৯ টাকা এবং শেয়ার মূল্য রয়েছে ৪.৮০ টাকা।
আমিনুল ইসলাম,বিশেষ প্রতিনিধি