পুঁজিবাজারে পুঁজির নিরাপত্তা দিবে কে, টানা দরপতন রহস্যময়!
শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে টালমাতাল আচরণে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের। ফলে টানা দরপতনে চলছে বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ। আর অস্থিরবাজারে প্রায় প্রতিদিনই মূল্যসূচক কমছে। এরচেয়েও বেশি কমছে শেয়ারের দাম। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের অনেকেই যে কোনো মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যেতে মরিয়া হয়ে উঠছেন।
তাতে বাজারে বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে। ফলে দেখে মনে হচ্ছে পুঁজিবাজার যেন এক আতঙ্কের নাম। তবে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত জুন-জুলাই ও আগস্ট মাসে পুঁজিবাজারে কিছুটা গতিশীলতা ফিরে পেয়েছিল।
পাশাপাশি সূচকের ঊর্ধ্বগতি, লেনদেন বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত বাজারকে নতুন সম্ভাবনার দিকে পরিচালিত করছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত ও অযৌক্তিক পদক্ষেপের কারণে সেই ইতিবাচক ধারা থমকে যায়।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের একের পর এক পুঁজিবাজার ইস্যুতে নেতিবাচক সিদ্ধান্তে বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। বিশেষ করে পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরন সিদ্ধান্ত ও ৯ আর্থিক খাতের শেয়ারের ডি লিস্টিং ইস্যু। এসব সিদ্ধান্তের কারনে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক ধারনা সৃষ্টি হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে পুঁজিবাজার অবিভাবকহীন।
যার ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সম্প্রতি অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে। অর্থাৎ যেখানে অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পুঁজিবাজার একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেখানে আমাদের দেশে পুঁজিবাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান আর পুঁজিবাজার কাঙ্খিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও।
সে ধারাবাহিকতায় গত বছর পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন অব্যাহতভাবে অবদমিত হয়েছে। অন্যদিকে বছরজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা, ব্যাংক খাতে অস্থিরতা ও বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ হ্রাসসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পুঁজিবাজারে মন্দা ভাব বিরাজ করছে। সে কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা অর্জন করতে পারেনি। তবে মাঝে মধ্যে ক্ষণিকের জন্য ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হলেও নিমেষেই সে গতির দিক পরিবর্তিত হয়ে যায়।
এ কারণে পুঁজিবাজারে সক্রিয় হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে।
অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে দেশের পুঁজিবাজারে প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায়, যা দেশের এ পুঁজিবাজারের দুরবস্থাসংক্রান্ত তথ্যাদি হরহামেশাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভালো কোনো পূর্বাভাসের খবর দিচ্ছে না। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফা নিতে পারছে না। এ জন্য তারা ভালো লভ্যাংশও দিচ্ছে না।
সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের পুঁজিবাজার কখনো আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির সহযাত্রী ছিল না। তাই এক যুগ ধরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এত উন্নয়নের মধ্যেও পুঁজিবাজারে দৈন্যদশা। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ অর্থনীতির এ নিয়মগুলো বিবেচনায় আনা উচিত ছিল। তবে এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন, বিনিয়োগকারীরা যে শেয়ারে বিনিয়োগ করবে সেটা বিনিয়োগযোগ্য কি না তা বিশ্লেষণ করা।
পরিতাপের বিষয় যে আমাদের দেশে সে মানের বিনিয়োগকারী গড়ে ওঠেনি। আর এটিও কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকারান্তরে এক ধরনের বড় ব্যর্থতা। এর কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সকাল-সন্ধ্যা বিভিন্ন নীতিমালার পরিবর্তন ও বিতর্কিত বড় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়ে রোড শো বা প্রকাশ্যে কারো প্রশংসা করছে।
এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা শেয়ারের চলতি বাজারমূল্যে নাকি ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করা হবে তা নিয়ে এক যুগেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তদ্রুপ পুঁজিবাজারের নিজস্ব গতিতে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে সাপোর্ট লেভেল তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু তা কখনো হয়নি। ক্ষেত্র বিশেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দ্বারস্থ হয়।
এ ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগকারীরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুরোধে নিজেদের মোক্ষম সময়ে বাজার থেকে কম দামে শেয়ার কিনতে থাকেন। এর ফলে লেনদেন চাঙ্গা হয় আর সূচকেও উল্লম্ফন দেখা যায়। বিশেষত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে বেড়ায় বাজার পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আবার বাজারমুখী হন।
অবশেষে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে বেশি দরে শেয়ার চাপিয়ে দিয়ে প্রস্থান করে বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহযোগিতার ফলে বড় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে কারসাজি করছে। আবার তারা পর্যবেক্ষণে থাকে ও দূরে বসে বাজারের তামাশা দেখে। এ ঘটনার আবর্তেই চলছে পুঁজিবাজার। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
এছাড়া অনভিজ্ঞ ও অদূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বিনিয়োগকারীরা আবারও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় বাজারের স্থিতিশীলতা গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ফলে বিএসইসি’র বর্তমান চেয়ারম্যানের পুঁজিবাজার বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বাজারের বাস্তব পরিস্থিতি ও বিনিয়োগকারীদের মনোভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন।অতীতে ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসও মূলত অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও তদারকির ঘাটতির কারণেই ঘটেছিল। সেই ধসের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে বিনিয়োগকারীদের প্রায় এক দশক লেগেছিল।
বর্তমান পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আবারও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে অবিলম্বে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা বাজারকে অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করবে।

