শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ গত ৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম হয়েছে। মুলত দেশের বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পুঁজিবাজারে বেশ ভালোভাবে লেগেছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তা আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পুঁজিবাজারের যে বেহাল দশা তার জন্য বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশাও একটি কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। মুলত টালমাটাল পুঁজিবাজারে দেশী বিনিয়োগকারীদের মতোই বিদেশীদের মধ্যে রয়েছে পুঁজি হারানোর ভয়। এ ভয়ে প্রবাসী ও বিদেশীরা শেয়ার বিক্রি করছেন। তারা যে শুধু ঝুঁকি কমাতেই শেয়ার বিক্রি করছেন তা নয়; বরং টাকা নিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়েই চলে যাচ্ছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করেই স্থানীয় বা আঞ্চলিক পুঁজিবাজার বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। একটি দেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগের জন্য কতটা উপযুক্ত সেটিও বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। যদিও দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ আট বছরের বেশি সময় ধরে ক্রমেই কমছে। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছেন বেশি।

তথ্যে দেখা যায়, দেশের পুঁজিবাজারে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বিদেশি বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে মোট বাজার মূলধনের ৩ দশমিক ৭ শতাংশে। বর্তমানে পুজিবাজারে মোট বিদেশি বিনিয়োগ ২৩৩ কোটি ডলার। ২০১৫ সালের পর এত কম বিদেশি বিনিয়োগ দেখা যায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। পুঁজিবাজারে ২০১৯ সালে বাজার মূলধনে বিদেশি মালিকানায় ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশের বেশি কমে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি বিনিযোগ ছিল ২৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে সুশাসনের অভাব, টাকার অবমূল্যায়ন এবং ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের কারণে গত অর্থবছরে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুলত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগে। সংকটের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন তারা।

বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এফডিআই আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। কিন্তু এই ইতিবাচক ধারার মধ্যে পুঁজিবাজারে বিদেশি না আসায় হতাশ হয়েছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে চলা বাজারের মন্দাবস্থাই এর কারণ বলে মনে করছেন তারা।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যেকোনো পুঁজিবাজারে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ থাকা ভালো। আমাদের বাজারেও তেমনটাই ছিল। কিন্তু ২০০৯-১০ সালে বাজারে বড় ধসের পর ৪-৫ বছর বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। ২০১৫ সাল থেকে কিছুটা আসতে শুরু করে।

মাঝে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভালোই বিনিয়োগ করেছিল। ২০২০ সালে বাজারে যে একটা ধস হয়েছে সে আতঙ্কে অনেকে চলে গেছে। আর আসেনি। এখন সামান্য যে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, সেটা আগে বিনিয়োগ করা। বাজার সুস্থ-স্বাভাবিক না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে না বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিষ্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, মূলত সুশাসনের অভাব, টাকার অবমূল্যায়ন ও ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর কারণে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বেশ কয়েকটি রোড শো করলেও তা কাজে আসেনি।

রোড শোর মাধ্যমে বিএসইসি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে ঢুকলেই দেখছে যে, দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিগুলো এখানের পুঁজিবাজারে আধিপত্য বিস্তার করে।

তথ্যে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্য খাতের মধ্যে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কেমিক্যালস খাতে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে ৫৮ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪২ দশমিক ১ শতাংশ, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা এবং মিউচুয়াল ফান্ডে ২৭ কোটি ২৫ লাখ মার্কিন ডলার বা ২৫ শতাংশ, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে ১৯ কোটি ৫৮ লাখ মার্কিন ডলার বা ১৬ দশমিক ২ শতাংশ।

তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে ৬২ কোটি ৯৮ লাখ মার্কিন ডলার বা ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ, লুক্সেমবার্গের বিনিয়োগকারীদের ১৪ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার বা ১২ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বা ১১ দশমিক ২ শতাংশ।

আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে রোড শো করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। রোডশোর পর এদেশের বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। তবে ২.১৮ শতাংশ ০.৪৫ শতাংশ সাম্প্রতিক সময়ে ওষুধের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় ভালো করায় এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে।