শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের কোম্পানি ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি চলছে। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের অর্ধেকের বেশিই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে সংস্থান ও মূলধন ঘাটতি। সম্পদের গুণগত মান দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় পুঞ্জীভূত লোকসান দিন দিন বাড়ছে। ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রতি ব্যাপক আস্থার সংকট থাকায় নতুন করে আমানতও পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।

তীব্র তারল্য সংকটে পড়তে হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি দিন দিন প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বেড়েই চলছে। এজন্য গত কয়েকবছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিচ্ছে না কোম্পানিটির। সার্বিক আর্থিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের এমন দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।

ব্যাংক বহির্ভূত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির এমন দুর্দশার জন্য অযোগ্য নেতৃত্বকে দায়ী করছে খাতসংশ্লিষ্টরা। অযোগ্য নেতৃত্বের ফলে প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক বছর ধরে লোকসানে রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের দেয়া তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের পর ফিনিক্স ফাইন্যান্স শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। ২০২০ সালে আয় করেও লভ্যাংশ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে কোম্পানিটি লোকসানে রয়েছে, যা ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বশেষ চলতি হিসাববছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও প্রায় ১৬০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই,২৩-সেপ্টেম্বর,২৩) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ৯ টাকা ৬০ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ১ টাকা ৫১ পয়সা। অপরদিকে, ৯ মাসে (জানুয়ারি,২৩-সেপ্টেম্বর,২৩) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ২৩ টাকা ০৭ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ১ টাকা ৫০ পয়সা। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভি) ঋণাত্বক হয়েছে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা।

খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের বর্তমান দুরবস্থার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম ইন্তেখাব আলমের অযোগ্য নেতৃত্বই দায়ী। কারণ শীর্ষ পদটিতে ২০০৮ সাল থেকে টানা ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। গত দুই বছর টানা লোকসানে থাকলেও তাকে প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ কর্তৃক এমডি হিসেবে আরও এক মেয়াদে রাখার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। আর এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনাপত্তির জন্য পাঠানোও হয়েছিল। তবে এ দফায় তার মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনাপত্তি দিতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ক্রমাগত লোকসানের অন্যতম কারণ হচ্ছে নামে-বেনামে ঋণ দেয়া। কোম্পানিটি বিভিন্ন সময় ঋণ দিলেও সেটি পরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে একসময় নতুন মূলধন জোগান ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আর্থিক খাতের যত অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়েছে, তার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে জামানতবিহীন কিংবা ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার তথ্য মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে জামানত নিলেও তা অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুয়া গ্যারান্টির বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। আর এ তালিকার প্রথম দিকেই আছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশদ পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এ পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করা হবে।

ফিনিক্স ফাইন্যান্সের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই ব্যতীত ও ডিউ ডিলিজেন্সের (ঋণ নিয়মাচার) ব্যত্যয় ঘটিয়ে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণ করায় সময়মতো ফেরত পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। আবার ঋণ আদায়ে যথাযথ তদারকির অভাবও রয়েছে। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, যা ইতোমধ্যেই উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। এ ছাড়া অন্যান্য আর্থিক সূচকেও ক্রমশ অবনতি হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানার জন্য ফিনিক্স ফাইন্যান্সের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ সায়েদুজ্জামানকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ফলে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, তারল্য সমস্যা, সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থতা, সংস্থান ঘাটতি, ঘাটতি সংস্থান সংরক্ষণের ডেফারেল সুবিধা গ্রহণ, গ্রাহকদের আমানতের টাকা মেয়াদপূর্তিতে ফেরত না দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গতবছরের ১৩ অক্টোবর ফিনিক্স ফাইন্যান্সসহ ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বৈঠকে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের বর্তমান আর্থিক অবস্থার জন্য করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রভাবকে দায়ী করে প্রতিষ্ঠানটির এমডি বলেন, দ্বিতীয় দফায় কোভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন আর্থিক সমস্যায় পতিত হয়।

ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ মামলায় আটকে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বৈঠকে আরও জানান, ব্যবস্থাপনা পর্ষদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও কিছু ঋণ পুনঃতফসিলের পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মূলধন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাটির মোট বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬০৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

আর চলতি বছরের মার্চে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬৭ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা তখনই উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, যাচাই-বাছাই, ডিউ ডিলিজেন্স এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৪ ধারার নির্দেশনার ব্যত্যয়ে ঘটিয়ে পর্যাপ্ত জামানত দ্বারা আচ্ছাদিতকরণ ব্যতিরেকে ঋণ বিতরণ করা এবং ঋণ আদায়ে তদারকির অভাবের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত মার্চ পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আরও দুই প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৪ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি। আর সর্বশেষ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হিসাবে খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের হার উঠেছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতিও বাড়ছে।

এ ঘাটতিপূরণে গত কয়েক বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টানা ডেফারেল সুবিধাও নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও প্রতি প্রান্তিকে সংস্থান ঘাটতি থাকছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির সংস্থান ঘাটতি ছিল ৮৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মূলধন উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা থাকলেও গত বছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৯১ কোটি টাকা। বর্তমানে এই ঘাটতি শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ থাকলেও গত বছর শেষে তা হ্রাস পেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমেছে। এক্ষেত্রেও পতনের ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সার্বিক অব্যবস্থাপনার ফলে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের গুণগত মান হ্রাস ও ক্রমাগত লোকসান বৃদ্ধির কারণে মূলধন ঘাটতি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এছাড়াও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না লোকসানে থাকা ফিনিক্স ফাইন্যান্স। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সূচকে ক্রমাবনতিসহ ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রমে বিবিধ অনিয়মের কারণে আস্থা সংকটে পড়ে তীব্র তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, আমানতকারীদের অর্থ মেয়াদপূর্তিতে ফেরত প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত প্রদান না করা সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা চরম অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সংকটের পরিচায়ক।

ক্রমাগত লোকসান বাড়তে থাকা ফিনিক্স ফাইন্যান্স সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানা গেছে। গ্রাহকদের টাকার সুরক্ষায় বর্তমানে মেয়াদি আমানত গ্রহণকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বি-সাপ্তাহিক ভিত্তিতে গড়ে দৈনিক ১ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে সিআরআর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সংরক্ষণ করতে হয়। তবে যে কোনো দিনই এ সংরক্ষণের পরিমাণ ১ শতাংশের কম হবে না। অপরদিকে মেয়াদি আমানত গ্রহণকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসএলআর হিসেবে ৫ শতাংশ এবং আমানত গ্রহণ করে না এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এসএলআর হিসেবে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়।

জানা গেছে, সব আর্থিক সূচকে অবনতি ও প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে ক্যামেলস রেটিংয়েও হতাশা বিরাজ করছে। ২০১৮ সালে ক্যামেলস রেটিং ‘সন্তোষজনক’ মান পেলেও সর্বশেষ ২০২১ সালে তা ‘মোটামুটি’ মানে নেমে গেছে। আগের দুই বছর এই রেটিংয়ের মান ছিল ‘ফেয়ার বা ভালো’। ক্যামেলস রেটিং হচ্ছে ব্যাংকগুলোর পারফরমেন্সের একটি নির্দেশক। সাধারণত ব্যাংকের মূলধনের অবস্থা, আয়-ব্যয়, ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয় এতে প্রতিফলিত হয়।