শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ভালো মুনাফা দেখিয়ে ২০২১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার ডিস্টিবিউশন পিএলসি। তালিকাভুক্ত হওয়ার মাত্র দুই বছর পার হতে না হতেই লোকসানের মুখে পড়েছে কোম্পানিটি। লোকসানের সঙ্গে ঋণও বেড়েছে পাহাড় সমান।

মুলত আকর্ষণীয় ব্যবসা দেখিয়ে প্রিমিয়াম প্রাইসে, অর্থাৎ ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসি। পুঁজিবাজারে আসার আগে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ৪৭ কোটি টাকা। অথচ দুই বছর না পেরোতেই মুনাফা থেকে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কোম্পানির তথ্য মতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৯ এবং ২০২০ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ছিল যথাক্রমে ৩.১৩ টাকা ও ৩.৮৩ টাকা। তালিকাভুক্ত হওয়ার বছরই ইপিএস আগের বছরের চেয়ে ০.৮০ টাকা কমে দাঁড়ায় ৩.০৩ টাকায়। এরপরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে আরও কমে যায় ইপিএস। ওই বছর নামমাত্র ০.৩৮ টাকা ইপিএস দেখিয়েছে কোম্পানিটি। আর চলতি বছরে লাভের পরিবর্তে শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখিয়েছে কোম্পানিটি।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের আর্থিক প্রতিবেদনেই স্বীকার করেছে যে, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার লিমিটেড জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ সালে মুনাফার পরিবর্তে শেয়ার প্রতি লোকসান করেছে ২.৩৬ টাকা। এতে কোম্পানির মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি ৮৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৯ টাকা। এনার্জিপ্যাক যে শুধু লোকসানে পড়েছে তাই নয়, মাত্র ১৯০.২০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনী কোম্পানিটির স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ রয়েছে ১,২৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির মূলধনের তুলনায় ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৬ গুণ বেশি। অথচ ২০২২ সালে কোম্পানির মুনাফা হয়েছিল ৭ কোটি ২২ লাখ ৬২ হাজার টাকা। ২০২১ সালে মুনাফা ছিল ৩৮ কোটি ৬০ লাখ ৩১ হাজার ৩২৮ টাকা।

এছাড়া সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরের সমন্বিত আর্থিক হিসাব অনুসারে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসির (ইপিজিপিএলসি) শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ৩৬ পয়সা লোকসান হয়েছে। আগের আগের হিসাব বছরে ৫১ পয়সা শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল। মূলত সাবসিডিয়ারি (সহায়ক) প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছেড়ে দেয়ার কারণে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে। অন্যদিকে একক আর্থিক হিসাবে কোম্পানিটি মুনাফায় থাকলেও আগের তুলনায় মুনাফা কমেছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক প্রতিবেদন স্ফীত করে দেখিয়ে পুঁজিবাজারে আসার প্রবণতা নতুন নয়। অনেক কোম্পানি এসব ছলচাতুরী করেছে। অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুঁজিবাজারে এলেও পরবর্তী সময়ে এসব কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের ঠকতে হয়েছে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে আসার পরই কেন লোকসানে পড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। যদি আর্থিক প্রতিবেদন তৈরিতে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে এই প্রবণতা কমে আসবে। পুঁজিবাজারে আসার আগে প্রসপেক্টাসে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য এনার্জিপ্যাকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) উল্লেখ করা হয় ৩ টাকা ১৩ পয়সা, আর নিট মুনাফা দেখানো হয়েছিল ৪৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

এমন আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসভ্যালু ১০ টাকার সঙ্গে দাম বা প্রিমিয়াম প্রাইসে পুঁজিবাজারে আসার অনুমোদন পায় এনার্জিপ্যাক পাওয়ার। যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রতিটি শেয়ার ৩৫ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রতিটি ৩১ টাকায় ইস্যু করে কোম্পানিটি।
ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছিল এনার্জিপ্যাক। অথচ ব্যবসায় সমৃদ্ধি আসা তো দূরে থাক, উল্টো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পরই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হতে থাকে।

পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পর ব্যবসায় পতন ১৯৬ শতাংশ। শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার। এই বিনিয়োগের বিপরীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ব্যবসায় শুধু সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ৫ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ৫০ পয়সা লভ্যাংশ পাবেন। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের বিপরীতে এই রিটার্নের পরিমাণ খুবই নগণ্য।

৩৫ টাকার বিপরীতে যা ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং ৩১ টাকার বিপরীতে ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। অথচ যেকোনো ব্যাংকে স্থায়ী আমানত বা এফডিআর করলে এর থেকে অনেক বেশি মুনাফা পাওয়া সম্ভব। তবে আগের অর্থবছরের ব্যবসায় ১০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ১ টাকা নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল কোম্পানিটি।

এ বিষয়ে কথা বলতে কোম্পানির সচিব আলাউদ্দিন শিবলীর মোবাইল নম্বরে বারবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ইস্যু ম্যানেজার লঙ্কবাংলা ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে বুক বিল্ডিংয়ে পুঁজিবাজারে আসে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার। গত ২৩ জুলাই থেকে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩৪ টাকা ৫০ পয়সায় রয়েছে, যা শেয়ারটির ফ্লোর প্রাইস। অন্যথায় অনেক আগেই এর দর তলানিতে চলে আসতে পারত বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। কথা ছিল উত্তোলিত টাকায় এলপিজি ব্যবসা সম্প্রসারণ, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও আইপিও প্রক্রিয়ার খরচ নির্বাহে ব্যয় করবে কোম্পানিটি। এর ফলে একদিকে কোম্পানির ঋণ কমবে, অন্যদিকে ব্যবসাও বাড়বে। কিন্তু তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ না কমে বরং আরো বেড়ে গিয়েছে। আর মুনাফা থাকা কোম্পানিটি পড়েছে লোকসানে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের মুনাফার পরিবর্তে এখন লোকসান পোহাতে হচ্ছে।