শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ, নতুন করে উৎপাদনে ফেরার কোনো খবরও নেই। অর্ধযুগ ধরে করতে পারেনি বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম)। এক দশক ধরে শেয়ারহোল্ডারদের দিচ্ছে না কোনো লভ্যাংশ। রয়েছে ঋণের ভার। ‘জুট স্পিনার্স লিমিটেড’ নামে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম গত দুই মাসে বেড়েছে ৮০ টাকার বেশি। মূলত ‘গুজব’ ছড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্র। বিষয়টি কারসাজি কি না, তা খতিয়ে দেখছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, ১৫ জুন থেকে শেয়ারটির দাম বাড়ছে। চলতি বছরের ১৫ জুন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছিল ১২৫ টাকা ৯০ পয়সায়। সেখান থেকে গত দুই মাসে ৮০ টাকা বেড়ে রোববার (২১ আগস্ট) লেনদেন হয়েছে ২০৬ টাকা ১০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ারের দাম বড়েছে ৮০ টাকা ২০ পয়সা। কোম্পানিটির ১৭ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৬০ দশমিক ১৮ শতাংশ। বাকি ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে।

‘শিগগিরই ঋণ পরিশোধ করে কোম্পানিটি উৎপাদনে ফিরবে’ বাজারে এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারটির দাম ৩০০ টাকা পর্যন্ত যাবে বলেও গুজব ছাড়নো হচ্ছে। যদিও কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী সৈকত হোসেন বলেন, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার বড় ভাই বলেছিলেন শেয়ারটি কিনে রাখতে, দাম বাড়বে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় আমি তার কথা শুনিনি। এখন দেখি না কিনে ভুল করলাম।

নাম না প্রকাশ শর্তে লঙ্কাবাংলার এক ট্রেডার বলেন, কোম্পানির পক্ষ থেকেই আমাকে বলেছিল তাদের সমস্যাগুলো কেটে গেছে, শিগগিরই উৎপাদনে যাবে। আমি আমার ক্লায়েন্টদের বলেছি, কয়েকজন শেয়ারও কিনেছে, এখন তারা লাভ পেয়েছে।

খবরটি সতত্য যাচাইয়ের জন্য মোবাইল ফোনে জুট স্পিনার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শামস-উজ জোহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো খবর নেই। কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) তোফাজ্জাল হোসেন বলেন, আমাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

কোম্পানির তথ্য মতে, ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটাল ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার। প্রায় ২ কোটি টাকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্য চলতি বছরের ১৫ জুন ছিল ২১ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কারণ সেই দিন পর্যন্ত ১০ টাকার শেয়ারের মূল্য ছিল ১২৫ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে গত ২ মাস ৫ দিনে ৮০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ২০৬ টাকা ১০ পয়সা দরে। তাতে কোম্পানির বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসে ১৭ লাখ শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা হয়েছে ১৩ কোটি ৬৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কি না, জানতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে। চিঠির জবাবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ডিএসইকে জানিয়েছে যে, তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। আর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ারটির দাম বাড়ার পেছনে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এবিষয়ে ডিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসার (সিআরও) খায়রুল বাসার আবু তাহের মোহাম্মদ বলেন, খালি চোখে দেখা যাচ্ছে শেয়ারটিতে কিছু একটা হচ্ছে। তাই কোম্পানির কাছে দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো তথ্য আছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছে। কোম্পানি বলেছে তাদের কাছে কোনো সংবেদনশীল তথ্য জানা নেই। বিষয়টি আমরা কমিশনকে অভিহিত করব।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারসাজি হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, মালিকানার দ্বন্দ্বে বছরের পর বছর ব্যবসায় লোকসানের পাশাপাশি অর্ধযুগ ধরে উৎপাদন বন্ধ, নগদ অর্থ সংকট ও পাওনাদারদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থতাসহ ঋণের ভারে জর্জরিত জুট স্পিনার্স লিমিটেড এখন অস্তিত্ব সংকটে। বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পৌনে দুই কোটি টাকার কোম্পানির ব্যাংক ঋণ ৪৯ কোটি টাকা! এর সঙ্গে গত এক দশকে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির সম্পদের চেয়ে লোকসান অনেক বেশি।

ডিএসইর তথ্য মতে, জুট স্পিনার্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শামস-উল হকের মৃত্যু হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকে তার ছেলেরা কারখানাসহ সম্পদের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে জাড়িয়ে পড়েন। শামস-উল হকের মৃত্যুর প্রথম দুই বছর অর্থাৎ ২০১২ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। এরপর থেকে ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিক জটিলতায় লোকসানে নিমজ্জিত হয় কোম্পানিটি। একপর্যায়ে চালাতে না পেরে ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যা এখনো বন্ধ রয়েছে।

জুট স্পিনার্স লিমিটেডের সার্বিক অবস্থা: কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট লোকসান হয়েছে সাত কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) তিন প্রান্তিকে লোকসান আরও বেড়েছে। এ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুসারে, শেয়ারপ্রতি কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১০ টাকা ৮৩ পয়সা। ফলে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ টাকা ৭ পয়সায়।

কোম্পানির ঋণ: ১৯৮৪ সালে তালিকাভুক্ত এক কোটি ৭০ লাখ টাকার পরিশোধিত কোম্পানিটির ৪৯ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে। তবে, ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেখানো হয়েছে ৪০ কোটি ৬৮ লাখ ছয় হাজার টাকার ঋণ। এর মধ্যে ৩১ কোটি ৭৭ লাখ ছয় হাজার টাকা স্বল্পমেয়াদি এবং আট কোটি ৯১ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।

এ ঋণের সঙ্গে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঋণ ও লোকসান মিলে কোম্পানির কাছে পাওনা ৭৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানির সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১০ দশমিক ২০ এককর জমি, কারখানা ও মেশিন।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ: ২০১৬ সালের অডিট প্রতিবেদনে নিরীক্ষক শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানি দেখিয়েছে, জুট স্পিনার্সের শ্রমিক জটিলতা, পাওনাদারদের টাকা পরিশোধে অক্ষমতা এবং ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস)-৩৬ অনুযায়ী প্রতি বছর কোম্পানির সম্পদ মূল্যায়ন শেষে ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট বাধ্যতামূলক (যদি থাকে)।

পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ প্রতিষ্ঠানটির। ফলে আর্থিক বিবরণীতে সম্পদের প্রকৃত বাজারদরে পার্থক্য হওয়াটা স্বাভাবিক। এরপরও কর্তৃপক্ষ ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট (বৈকল্য পরীক্ষা) করেনি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার রেজুলেশন ছাড়াই এমডির কাছ থেকে দুই কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এমডি ছাড়াও পরিচালক মুহাম্মদ শামস-উল-কাদিরের স্ত্রী আয়েশা কবিরের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ৩৫ লাখ টাকা এখনও পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু সেই অর্থের ওপর গত পাঁচ বছরের জন্য ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার সুদ ধরা হয়েছে। এভাবে জুট স্পিনার্স কর্তৃপক্ষ কোম্পানি আইন ও ইনকাম ট্যাক্স অধ্যাদেশ ভঙ্গ করে পরিচালকদের সঙ্গে অধিকাংশ লেনদেন নগদে করেছে বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।