শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: সম্প্রতি পুঁজিবাজারে সাত ব্যাংকের ভালো লভ্যাংশ ঘোষণার পরও এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরে উন্নতি নেই। বছরের পর বছর ধরে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাত ব্যাংকের ২০২১ সালের ঘোষণা করা লভ্যাংশের চিত্র পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিলেও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারছে না। ফলে অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংকের শেয়ার দাম। অন্যদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আমানতের সুদের চেয়ে শেয়ারে লভ্যাংশ এবারও বেশি দিয়েছে বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।

কোম্পানিটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি আয় করেছে ৩ টাকা ৪৬ পয়সা। আগের বছর কোম্পানিটি প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে ২ টাকা ১৬ পয়সা আয় করতে পেরেছিল। ওই বছর বিনিয়োগকারীরা শেয়ার প্রতি ১ টাকা নগদের পাশাপাশি প্রতি ২০টি শেয়ারের বিপরীতে একটি করে বোনাস শেয়ার পেয়েছিলেন। এবার তারা পাবেন ১ টাকা ২৫ পয়সা ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার।

এদিকে ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে না পারার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন, ভালো লভ্যাংশ দিলেও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আবার ঋণ বিতরণ খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। মুনাফার সক্ষমতাও কমে গেছে। এসব কারণে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।

লভ্যাংশ ঘোষণার পর ব্যাংকের শেয়ার একটু বাড়লেও রেকর্ড ডেটের পর আবার দাম কমে যাচ্ছে। তার মানে হলো ব্যাংকের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। ব্যাংকের শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে রেখে ভালো বেনিফিট পাওয়া যাবে কি-না তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংশয় আছে।

তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিনিয়োগকারীরা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করছেন না। যে কারণে ব্যাংকের শেয়ার এখন সবচেয়ে অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। লভ্যাংশের বিষয় বিবেচনায় নিলে এখন ব্যাংকের শেয়ারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না। তারা দ্রুত মুনাফা তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য বুঝে না বুঝে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি আয় করেছে ৩ টাকা ৪৬ পয়সা। আগের বছর কোম্পানিটি প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে ২ টাকা ১৬ পয়সা আয় করতে পেরেছিল। ওই বছর বিনিয়োগকারীরা শেয়ার প্রতি ১ টাকা নগদের পাশাপাশি প্রতি ২০টি শেয়ারের বিপরীতে একটি করে বোনাস শেয়ার পেয়েছিলেন। এবার তারা পাবেন ১ টাকা ২৫ পয়সা ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার।

উত্তরা ব্যাংকের সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার যোগ হওয়ার পরেও মহামারির বছরে উত্তরা ব্যাংক আয় বাড়াতে পেরেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ৩ টাকা ৯৩ পয়সা আয় করতে পেরেছে। আগের বছর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় ছিল ৩ টাকা ৮০ পয়সা।

ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য জন্য বিনিয়োগকারীদেরকে শেয়ার প্রতি এক টাকা ৪০ পয়সা নগদ আর প্রতি একশ শেয়ারের বিপরীতে ১৪টি বোনাস শেয়ার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। আগের বছর শেয়ার প্রতি ১ টাকা ২৫ পয়সা নগদ আর সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল কোম্পানিটি। গত মঙ্গলবার কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়।

সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার যোগ হওয়ার পরেও মহামারির বছরে উত্তরা ব্যাংক আয় বাড়াতে পেরেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ৩ টাকা ৯৩ পয়সা আয় করতে পেরেছে। আগের বছর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় ছিল ৩ টাকা ৮০ পয়সা। কোম্পানিটির সম্পদমূল্যও বেড়েছে।

২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ার প্রতি সম্পদ ছিল ৩১ টাকা ১ পয়সার (বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর)। সেটি বেড়ে এবার হয়েছে ৩২ টাকা ৮৩পয়সা। যারা এই লভ্যাংশ নিতে চান, তাদেরকে ৬ এপ্রিল শেয়ার ধরে রাখতে হবে। অর্থাৎ সেদিন হবে রেকর্ড ডেট। এই লভ্যাংশ চূড়ান্ত করতে বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম ডাকা হয়েছে আগামী ২৮ এপ্রিল।

এছাড়া শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ২ টাকা ৫২ পয়সা। আগের বছর এই আয় ছিল ১ টাকা ৮৬ পয়সা। আয় বেড়েছে ৬৫ পয়সা বা ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আয় বাড়লেও গত বছরের চূড়ান্ত প্রান্তিক, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি আয় বেশ কম হয়েছে ব্যাংকটির।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিক শেষে তাদের শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ২ টাকা ৪৫ পয়সা। অর্থাৎ শেষ প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে সবচেয়ে কম ৭ পয়সা। আয়ের পাশাপাশি শেয়ারপ্রতি সম্পদও ব্যাপকভাবে বেড়েছে শাহজালালের। আগের বছর প্রতি শেয়ারের বিপরীতে ১৭ টাকা ৪৬ পয়সার সম্পদ ছিল।

এবার তা বেড়ে হয়েছে ১৯ টাকা ১৭ পয়সা। যারা এই লভ্যাংশ নিতে চায়, তাদেরকে আগামী ৬ এপ্রিল পর্যন্ত শেয়ার ধরে রাখতে হবে। অর্থাৎ সেদিন হবে রেকর্ড ডেট। লভ্যাংশ চূড়ান্ত করতে বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম ডাকা হয়েছে ২৮ এপ্রিল।

ডাচবাংলা ব্যাংকের ব্যাংকটি আগের বছরের মতোই লভ্যাংশের একটি অংশ নগদে এবং একটি অংশ বোনাস হিসেবে দেবে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ শতাংশ, অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি এক টাকা ৭৫ পয়সা দেয়া হবে নগদে, বাকি ১০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০টি শেয়ারের বিপরীতে একটি দেয়া হবে বোনাস হিসেবে। আগের বছর ব্যাংকটি ১৫ শতাংশ করে নগদ ও বোনাস শেয়ার দিয়েছিল। এই হিসাবে ব্যাংকটি বোনাস কমিয়ে নগদ লভ্যাংশ বাড়িয়েছে।

গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের হিসাব পর্যালোচনা করে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সাড়ে ২৭ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আগের বছর লভ্যাংশ ছিল ৩০ শতাংশ। আগের বছর ব্যাংকটি ১৫ শতাংশ করে নগদ ও বোনাস শেয়ার দিয়েছিল। এই হিসাবে ব্যাংকটি বোনাস কমিয়ে নগদ লভ্যাংশ বাড়িয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডাচ্-বাংলার শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৮ টাকা ৭৯ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৮ টাকা ৬৯ পয়সা (১৫ শতাংশ বোনাস সমন্বয়ের পর)।

২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটি টানা নগদ লভ্যাংশ দেয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে বোনাস শেয়ার দিতে শুরু করে। ওই বছর ১৫০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি দুটি শেয়ারের বিপরীতে তিনটি বোনাস শেয়ার দেয়া হয়। এর পরের বছর লভ্যাংশ আসে ১০ শতাংশ বোনাস ও ১৫ শতাংশ নগদ। গত বছর তারা সেই বছরের তুলনায় লভ্যাংশ ৫ শতাংশ বাড়ায়। গত বছর করোনার সময় এই ব্যাংকটি মুনাফা বাড়িয়ে চমক দেখায়।

চলতি বছর প্রথম দুই প্রান্তিকে আগের বছরের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও তৃতীয় প্রান্তিক ও চতুর্থ প্রান্তিকে ভালো করে তারা গত বছরকেও ছাপিয়ে যায়। যারা এই লভ্যাংশ নিতে চান, তাদেরকে আগামী ২৮ মার্চ শেয়ার ধরে রাখতে হবে। অর্থাৎ সেদিনই হবে রেকর্ড ডেট। এই লভ্যাংশ চূড়ান্ত করতে বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম ডাকা হয়েছে আগামী ২৪ এপ্রিল। এজিএমে লভ্যাংশ পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও এর প্রবণতা খুব একটা বেশি দেখা যায় না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর পুঁজিবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। একের পর এক ব্যাংকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ হিসেবে মাত্রারিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়েছে। এতে একদিকে ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা কমেছে।

যে কারণে কয়েক বছর ধরে বেশিরভাগ ব্যাংক লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বোনাস শেয়ার নির্ভর হয়ে পড়েছে। লভ্যাংশের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বর্তমানে ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগের জন্য সব চেয়ে বেশি উপযুক্ত। কিন্তু ভালো লভ্যাংশ দেয়ার পরও ব্যাংকের শেয়ার দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এর কারণ আমাদের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না।

তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বোনাস শেয়ার নির্ভর হয়ে পড়ায় বিনিয়োগকারীরা বাস্তবে খুব একটা লাভবান হননি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেয়ারের মূল্যে। ফলে অনেক ব্যাংকের শেয়ার এখন নামমাত্র দামে বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজার ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারার মূল কারণ ব্যাংক খাত। ব্যাংকের অনেক পরিচালক উচ্চ দামে বাজারে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন দাম কমার পরও তারা সেই শেয়ার কিনছেন না। যে কারণে এখন ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা পরও ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।

যদি পুঁজিবাজারে ব্যাংক ভালো করতো তাহলে সূচক অনেক বেড়ে যেত এবং বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ত। লভ্যাংশ ঘোষণার পর ব্যাংকের শেয়ার একটু বাড়লেও রেকর্ড ডেটের পর আবার দাম কমে যাচ্ছে। তার মানে হলো ব্যাংকের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়লেও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত এখনো সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের প্রফিট অ্যাবিলিটি (মুনাফার সক্ষমতা) কমে গেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ বিতরণের হারও খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। এসব কারণে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, লভ্যাংশের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বর্তমানে ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগের জন্য সব চেয়ে বেশি উপযুক্ত। কিন্তু ভালো লভ্যাংশ দেয়ার পরও ব্যাংকের শেয়ার দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এর কারণ আমাদের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না।সুত্র : দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকম