শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরত্বে থেকেও ভালোই টের পাওয়া গেছে দেশের পুুঁজিবাজারে। ফলে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স পয়েন্ট হারিয়েছে প্রায় ৫০০। এ অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপে এরই মধ্যে ঘুরেও দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ফলে গত সপ্তাহের শেষ তিন কার্যদিবস দুইশত পয়েন্ট সূচক বেড়ে ঘুরে দাঁড়াতো শুরু করে পুঁজিবাজার।

আজ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সূচকের বড় উত্থানে লেনদেন শেষ হয়েছে। ফলে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার আতঙ্কে কেটে স্থিতিশীলতার পথে হাঁটতে শুরু করছে পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুরোধে বাজার সাপোর্ট দিতে সক্রিয় হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। মুলত পুঁজিবাজারে পাঁচ ইস্যুতে স্থিতিশীলতার পথে হাঁটছে পুঁজিবাজার। শিগগিরই লেনদেন বাড়ার পূর্বাভাষ দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।

প্রথমত, পুঁজিবাজারের দরপতন থামাতে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের দর কমার ক্ষেত্রে ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার নির্ধারণ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের দর আগের দিনের সমাপনী মূল্যের তুলনায় সর্বোচ্চ ২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারবে। তবে সিকিউরিটিজের দর বাড়ার ক্ষেত্রে সার্কিট ব্রেকার আগের মতো ১০ শতাংশই অপরিবর্তিত থাকবে।

দ্বিতীয়ত, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরামর্শ।
তৃতীয়ত, যেসব কোম্পানি বিশেষ তহবিলে এখনও ২০০ কোটি টাকা জমা দেয়নি, সেগুলো দ্রুত জমা দেবে, আর যেসব ব্যাংক টাকা জমা দিয়েও বিনিয়োগে যায়নি, তারা দ্রুত বিনিয়োগে যাবে।

চতুর্থত, যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের নিচে, সেগুলো দ্রুত ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে।

পঞ্চমত, বিএসইসি’র তিন প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেছে অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বিএসইসির তিন প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, যে সকল মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কাছে ফ্রি অর্থ পড়ে আছে, সেই অর্থ দিয়ে বাজারকে সাপোর্ট দেবে। বর্তমানে বাজারে অনেক শেয়ারের প্রাইস তলানিতে রয়েছে। যেগুলোতে বিনিয়োগ করলে সহজে লাভবান হওয়া যাবে, সেসব শেয়ারে তারা বিনিয়োগ করবে।

এছাড়া, অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টগুলোকে ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স এবং আর্থিক কোম্পানিগুলো টাকা দিতে আগ্রহী। সেজন্য ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তহবিল সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়েছে বিএসইসি। এই তিন বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একমত হয়েছে বিএসইসি।

এদিকে আজ ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯৭.৫৮ পয়েন্ট বা ১.৪৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭৬৫.৭৩ পয়েন্টে। আজ ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ১৭.৭৭ পয়েন্ট বা ১.২৩ শতাংশ এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৩৮.০৮ পয়েন্ট বা ১.৫৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৪৫৩.১৮ পয়েন্টে এবং দুই হাজার ৪৬৩.১৯ পয়েন্টে।

ডিএসইতে আজ টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৯৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। যা আগের দিন থেকে ৬২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা কম। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৬১ কোটি ২০ লাখ টাকার।

ডিএসইতে আজ ৩৮০টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৭৩টির বা ৭১.৮৪ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। দর কমেছে ৮৭টির বা ২২.৮৯ শতাংশের এবং ২০টি বা ৫.২৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এদিন ২৫১.৫০ পয়েন্ট বা ১.২৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮১৩.০৬ পয়েন্টে। এদিন সিএসইতে হাত বদল হওয়া ২৯৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ২১৫টির, কমেছে ৬০টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৮টির দর। আজ সিএসইতে ৪১ কোটি ৪১ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।

তবে একাধিক ব্যাংক খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন খাতের মৌলভিত্তির শেয়ারের উপর নজর দিচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মৌলভিত্তির শেয়ার ব্যাংকগুলোর প্রাধিকার। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা কম দরে মৌলভিত্তির শেয়ার ছাড়ছে না। যে কারণে ব্যাংকগুলো কাংখিত পর্যায়ে শেয়ার পাচ্ছে না এবং বাজারের লেনদেনও বাড়ছে না। তারা বলছেন, ‘ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক নিয়মে শেয়ার কিনে। কখনো টানাটানি করে শেয়ার কিনে না।’

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিএসইসি সার্কিট ব্রেকার নিয়ে ২ শতাংশের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা পৃথিবীর কোথাও নেই। এসব করে আসলে বাজারকে স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্ত বাজারের রুলসের বাইরে গিয়ে পরিপালন করা হচ্ছে। বরং বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দেওয়া উচিৎ। বাজারের ভালো ভালো কোম্পানি না আসলে বাজারে স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়।

এএফসি ক্যাপিটালের সিইও মাহবুব এইচ মজুমদার বলেন, বিএসইসি বাজারে স্থিতিশীল করার জন্য তাৎক্ষণিক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সময় উপযোগী। ব্যাংকগুলোকে তাদের বিনিয়োগের বিষয়ে মনে করিয়ে দেওয়া বা উৎসাহ দেওয়া, মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উৎসাহ দেওয়া খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। এই সমস্ত সিদ্ধান্ত বাজারের জন্য খুবই পজেটিভ।

তিনি আরও বলেন, ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার পৃথিবীর কোন বাজারে নেই। আমাদের দেশের এটি হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। বাজারের অতিরিক্ত পতন ঠেকানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। যা সাময়িক ভালো হলেও এটি যেন বেশি দিন না থাকে। কারণ বাজারের সাথে এমন সিদ্ধান্ত যায় না। এই সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পরে তুলে দিলেই বাজারের জন্য ভালো হবে

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছাইদুর রহমান বলেন, সম্প্রতি বিএসইসি’র পদক্ষেপগুলো বাজার বান্ধব সিদ্ধান্ত। একটা বড় ধাক্কা সামলে বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আশা করছি বাজার এখন আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাবে। গত কয়েক দিনের লেনদেনে তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’

লেনদেন সেভাবে না বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটা বড় ধসের পর সবাই এখন সতর্ক বিনিয়োগ করছে। সে কারণেই লেনদেন ধীরে ধীরে বাড়ছে। হঠাৎ করে বেশি লেনদেন হওয়াটাও কিন্তু বাজারের জন্য ভালো না। আমি মনে করি বর্তমান বাজারে এক-দেড় হাজার টাকা লেনদেন হলে মন্দ নয়। ‘তারা রাতারাতি বিনিয়োগ বাড়াবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। বাজারের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তারা বিনিয়োগ বাড়াাচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আমি আশা করছি।’ সুত্র: দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ