শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: টানা উত্থানের পর সম্প্রতি পুঁজিবাজারে টানা পতন চলছে। সূচকের সামান্য নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যে দিয়ে পতন শুরু হলেও দিন যত যাচ্ছে চলমান পতন তত বড় হচ্ছে। পতন যত বড় হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সম্প্রতি বড় পতন তাদের আরও ভাবিয়ে তুলছে। ফলে বাজার স্থিতিশীল হবে, এই ভেবে এতদিন যারা অপেক্ষা করছিলেন তারাও উৎকণ্ঠায় ভুগছেন। তবে বাজার পতনের মূলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট কাজ করছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু বাজারে এমন কোনো পরিস্থিতি হয়নি যার জন্য লাগাতার পতন হতে পারে। মূলত বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে পেনিক সেল করছেন, যার প্রভাবে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তাদের শেয়ার বিক্রয় চাপে বাজারে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের মনোগত কারণে পতন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তাদের আস্থা বাড়লে পুঁজিবাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি স্বাভাবিক। পুঁজিবাজারে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধি পাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা সহজে বিচলিত হন। ফলে পেনিক সেল বেড়ে যায়। তাই পতন নেমে আসে। কোনো কারণে বাজারে পতন নেমে এলে ভীত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং এ সময়ে তাদের ধৈর্যের পরিচয় দেয়া উচিত।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে দেখা যায়, প্রতিদিন কমে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া একযোগে কমছে তালিকাভুক্ত সব খাতের শেয়ারদর। এর জের ধরে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার মূলধন। গত ১১ কার্যদিবসে বাজার মূলধন কমেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে কমেছে সূচকও। এ সময়ের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচকও উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে। ১১ কার্যদিবসের ব্যবধানে সূচক হ্রাস পেয়েছে ৪৮২ পয়েন্ট। এর মধ্যে দিয়ে সূচক আবার সাত হাজার পয়েন্টের নিচে আসে। গতকাল দিন শেষে সূচকের অবস্থান হয়েছে ছয় হাজার ৮৮৫ পয়েন্ট।

এদিকে এ পরিস্থিতিতে ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা, বাড়ছে ক্ষোভ। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গতকাল অস্বাভাবিক দরপতন হলে কোনো উপায়ান্তর না দেখে রাস্তায় নামেন তারা। এ সময় তারা মতিঝিলে (পুরোনো) ডিএসই ভবনের সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান নেন।

তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে সিঁদুরে মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে তাদের অবস্থা করুণ হবে বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বাজার-সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক মন্তব্যের ওপরও আস্থা রাখতে পারছেন না তারা। কারণ পুঁজিবাজারে এর প্রতিফলন নেই।

তারা বলেন, সম্প্রতি বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছেন পুঁজিবাজার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। লেনদেন আর বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে বাজার-সংশ্লিষ্টদের কথার কোনো প্রভাব পড়ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সিকিউরিটি হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। এ কারণে কৃত্রিম তারল্য সংকট চলছে, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। এর জন্য দায়ী বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন আরও কম দরে শেয়ার কেনার।

অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছেন বাজার আরও ভালো হবে। আমিও তাই বিশ্বাস করি। বর্তমানে পরিস্থিতিতে বাজারের সার্বিক অবস্থা কেন এমন হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ থেকে বিরত আছেন। অর্থাৎ পতন ঠেকাতে দৃশ্যমান বাস্তব উদ্যোগ নেই। এমনকি সাধারণত দরপতনের সময় বিনিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও এখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিসহ সরকারি ব্যাংক সে ভূমিকায় নেই।

একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এপ্রিল থেকে একটানা উত্থানে বাজারে সূচক বেড়েছে প্রায় ২০০০ পয়েন্ট। এতে বেশির ভাগ শেয়ারের দামই বেড়েছে। তার মধ্যে কিছু শেয়ারের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। এখন বাজার পড়তে শুরু করায় সবাই মুনাফা তুলে নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।

প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। ফলে আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বাজার ধসের সময় সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারকে সার্পেট দেয়। কিন্তু আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে সেই নজির নেই। পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি দ্রুত যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কারন অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি প্রায় ৫০ শতাংশ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারেও ছিল। কিন্তু তা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে তাদের দিক থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ বা কঠোর নজরদারি নেই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে নিত্য নতুন গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

দরপতন বিষয়ে বাজারের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এ মুহূর্তের বাজারের সবচেয়ে বড় কারসাজির চক্র পরিকল্পিতভাবে শেয়ার বিক্রি করে বাজারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। চক্রটি গত কয়েকদিনে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে তাদের হাতে থাকা শেয়ার ব্যাপকভাবে বিক্রির আদেশ দেয়। এর প্রভাবে এসব হাউসের অন্য বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। এর ফলে দরপতন তরান্বিত হয়।

বাংলাদেশ সিকিরিটিজ অ্যাড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার উঠা-নামা স্বাভাবিক। বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। ধৈর্যের সাথে নিজেদের সম্পদ ধরে রাখতে হবে। এটা শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, দিনের পর দিন যখন মার্কেট বেড়েছে তখন তো কোন কথা হয়নি। বাজার যখন কয়েক দিন সংশোধন হচ্ছে, তখন ভয় বেড়ে যায়। আবার যখন প্রতিনিয়ত বাজার বাড়ে তখন ভয় কমে যায়। এটা স্বাভাবিক, এমনটা হতেই পারে। এজন্য বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।