শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারের আলোচিত-সমালোচিত সম্পদ ব্যবস্থাপক এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থানায় থাকা পুঁজিবাজারের ৬ ফান্ড ঝুঁকিতে। ইউনিটহোল্ডারদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ফান্ডগুলো তারল্যে রূপান্তর করা অথবা আইন অনুযায়ী সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি পরিবর্তন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরে আসার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন মতামত এসেছে।

এলআর গ্লোবালের বিভিন্ন অনিয়ম বিএসইসির নজরে আসার পর তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে বিএসইসি। গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক মোহাম্মদ এমদাদুল হক, মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান ও এএসএম মাহমুদুল হাসান। কমিটি ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে কমিশনে। বর্তমানে এটি এনফোর্সমেন্টে রয়েছে।

তদন্ত কমিটির ১০ পৃষ্টার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদে পদে অনিয়ম করেছে সম্পদ ব্যবস্থাপক এলআর গ্লোবাল। আইনকে তোয়াক্কা না করে বিভিন্নভাবে টাকা তসরুপ করেছে। লঙ্ঘন করা হয়েছে বিএসইসির একাধিক নির্দেশনা। এর আগেও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করেছিল বিএসইসি। জরিমানার পরও সঠিক পথে আসেমি সম্পদ ব্যবস্থাপক এলআর গ্লোবাল। ফলে প্রতিষ্ঠানটির কাছে থাকা ইউনিটহোল্ডারদের ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা অনিরাপদ মনে করছে বিএসইসির গঠিত তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা লঙ্ঘন করে জনগণের অর্থ রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি ও প্রতারণার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি বিডিনিউজ ও রংপুর ডিস্টিলারিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অর্থ দ্রুত ফেরত আনার সুপারিশ করেছে বিএসইসির তদন্ত কমিটি। তারা বলছে, আর্থিকভাবে ধুঁকতে থাকা বিডিনিউজের শেয়ারের দাম মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক। এমন অবস্থায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের টাকা এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনায় থাকা আর নিরাপদ নয়।

ফান্ডের আকার: এল আর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনাধীন ফান্ডগুলো চালুর সময়ে আকার ছিলো ডিবিএইচ প্রথম মিউচুয়াল ফান্ডের ১২০ কোটি টাকা, গ্রিনডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ডের ১৫০ কোটি টাকা, এআইবিএল প্রথম ও এমবিএল প্রথম মিউচুয়াল ফান্ডের ১০০ কোটি টাকা করে ২০০ কোটি টাকা, এলআর গ্লোবাল মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ানের ৩১১ কোটি টাকা এবং ১০৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান। সব মিলিয়ে তহবিলের মোট আকার প্রায় ৮৯০ কোটি টাকা। তবে ১৮ মার্চ ২০২১ এর বাজার দর অনুযায়ী ফান্ডের আকির হলো ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। যদিও ফান্ড চালুর পর থেকে এ যাবতকালে ইউনিটহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে দিয়েছে প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা।

বিডি নিউজে বিনিয়োগ: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বদল হয় ২০০৬ সালে। প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন এডিএন টেলিকমের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ মাহমুদ। ২০১৯ সালের মে মাসে আসিফ মাহমুদ নিজের হাতে থাকা ৮০ হাজার শেয়ার ৮০ লাখ টাকায় (প্রতি শেয়ারের দাম ১০০ টাকা) তৌফিক ইমরোজ খালিদীর কাছে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে আগের ২০ হাজার শেয়ারসহ মোট ১ লাখ শেয়ারের পুরোটার মালিকানা চলে যায় তৌফিক ইমরোজ খালিদীর কাছে।

এর মাত্র তিন মাসের মধ্যে তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার নামে থাকা কোম্পানির ২০ হাজার শেয়ার ২৫ কোটি টাকায় এবং আরও ২০ হাজার নতুন শেয়ার ইস্যু করে ২৫ কোটি টাকায় এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা (সিআইও) রিয়াজ ইসলামের কাছে বিক্রি করেন। তিন মাস আগের হিসাবে শেয়ারপ্রতি ১০০ টাকা হিসেবে ৪০ হাজার শেয়ারের দাম ৪০ লাখ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো বিক্রি হয়েছে ৫০ কোটি টাকায়। এ ক্ষেত্রে ১২ হাজার ৪০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয় ১২ হাজার ৫০০ টাকায়।

যেভাবে ব্যাপক অনিয়ম: বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিনিউজের ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন আসিফ মাহমুদ, বাকি ২০ শতাংশ ছিল তৌফিক ইমরোজ খালিদীর। প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত লোকসানে থাকায় একপর্যায়ে আসিফ মাহমুদ তার তার পুরো শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।

এ সময় ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দিদারুল আলমকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পদ মূল্যায়ন করে দেয়ার অনুরোধ করা হয়। দিদারুল আলম তখন সম্পদ মূল্যায়নের একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করে তৌফিক ইমরোজ খালিদীকে পাঠান, যেখানে কোনো চুক্তি, মূল্যায়ন ফি এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তের স্বাক্ষর ছিল না।

তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে দিদারুলকে উদ্ধৃত করা বলা হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তির আগে সম্পদ মূল্যায়নের এ ধরনের খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করা খুব সাধারণ একটি ঘটনা। বিডিনিউজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সরল বিশ্বাসে এ ধরনেরই একটি খসড়া পাঠানো হয়েছিল। কোনো ধরনের স্বাক্ষর ছাড়া পাঠানো ওই খসড়াটির উদ্দেশ্য ছিল, বিডিনিউজের সঙ্গে সম্পদ মূল্যায়নের আনুষ্ঠানিক চুক্তি করা। কিন্তু তৌফিক ইমরোজ খালিদী সেই খসড়া দেখিয়েই এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামের কাছে ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ বেশি দামে শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন।

বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-অভিবাসী রিয়াজ ইসলাম সেখানেই পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা। রিয়াজ ইসলাম ২০১৯ সালে ১০ সেপ্টেম্বর তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বাসায় যান। সেখানে বিডিনিউজে রিয়াজের বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয়।

পরে রিয়াজ ইসলাম ৫০ কোটি টাকায় ৪০ হাজার শেয়ার কেনেন। যেখানে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর ছিল ২০ হাজার শেয়ার এবং নতুন ইস্যু করা হয় আরও ২০ হাজার শেয়ার। এ-সংক্রান্ত খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির নিজস্ব তহবিল থেকে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের খবরে ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর জরুরিভিত্তিতে বিএসইসির ৭০০তম কমিশন সভা আহ্বান করা হয়। সেই সভা থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশকে বিনিয়োগ-সম্পর্কিত সমস্ত দলিল উপস্থাপন করার নির্দেশ দেয়া হয়।

এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন বিএসইসিকে একটি চিঠি দিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সম্পদের সঙ্গে সংগতিহীন বিপুল আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তথ্য জানতে চায়। বিএসইসি এরপর দুদকে পাঠানো চিঠিতে জানায়, বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় তদন্ত কার্যক্রম চলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এলআর গ্লোবাল এর আগেও ২০১৪ সালে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ৪৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ করে। বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের ৫৩৯তম সভায় আলোচনার পর এলআর গ্লোবালকে জরিমানা করা হয়। এলআর গ্লোবাল জরিমানার ১৫ শতাংশ পরিশোধের পাশাপাশি উচ্চ আদালতে রিট করে, যা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

বিডিনিউজে বিনিয়োগে অনিয়েমর বিষয়টি তদন্তে স্বশরীরে অনুসন্ধানও চালিয়েছেন বিএসইসির তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এলআর গ্লোবাল ও বিডিনিউজের কার্যালয়েও তারা পরিদর্শন করেন। তবে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সময় রিয়াজ ইসলাম ও তৌফিক ইমরোজ খালিদীর কাউকেই পাওয়া যায়নি।

এই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করা হয়। পাশাপাশি রিয়াজ ও খালিদীকে জবাব দিতে লিখিত প্রশ্ন দিয়ে আসে তদন্ত কমিটি। সেসব প্রশ্নের লিখিত জবাব, জব্দ করা নথি পরে বিশ্লেষণ করে এই কমিটি।

দুদকের মামলা: ২০২০ সালের ৩০ জুলাই তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর আগে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর জ্ঞাত আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে খালিদীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ১১ নভেম্বর দুদকে হাজির হয়ে খালিদী দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য দেন। এরপর তিনি উচ্চ আদালত থেকে স্থায়ী জামিন নেন।

দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার নামে থাকা কোম্পানির ২০ হাজার শেয়ার ২৫ কোটি টাকায় এবং আরও ২০ হাজার নতুন শেয়ার ইস্যু করে ২৫ কোটি টাকায় এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের সিইও রিয়াজ ইসলামের কাছে বিক্রি করেছেন। ওই ৪০ হাজার শেয়ারের প্রকৃত মূল্য শেয়ার প্রতি ১০০ টাকা হিসেবে ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু ১২ হাজার ৪০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকায়। এই প্রক্রিয়ায় এল আর গ্লোবাল পাবলিক মানি তছরুপ করেছে।

তবে দুদকের শুনানিতে তৌফিক ইমরোজ খালিদী দাবি করেন, ব্র্যাক-ইপিএল নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিডিনিউজের অ্যাসেট ভ্যালুয়েশন করে এবং তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ভ্যালুয়েশন দাঁড়ায় ৩৭১ কোটি টাকা। তবে প্রতিবেদনটিকে ভুয়া বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করে দুদক। ব্র্যাক ইপিএলের সিইও এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা লিখিতভাবে দুদককে জানায়, বিডিনিউজে তারা এ ধরনের প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

দুদক এজাহারে অভিযোগ করে, ওই ৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৪২ কোটি টাকাই খালিদীর ব্যাক্তিগত বিভিন্ন হিসাবে জমা করা হয়। অসাধু উপায়ে অর্জন করায় এটা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

এদিকে এন কে রায়ের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, দায়সহ বিডিনিউজের সম্পদমূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা। এটি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়। এছাড়া এটি স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানও নয়। এরপরেও তৌফিক ইমরোজ খালিদী ব্র্যাক ইপিএলের নাম ব্যবহার করে বিডিনিউজের অ্যাসেট ভ্যালুয়েশন করান। ওই মনগড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এলআর গ্লোবাল অস্বাভাবিক এবং কাল্পনিক দামে শেয়ার বিক্রি করে।

উদ্দেশ্য মানি লন্ডারিং: বিডিনিউজে এলআর গ্লোবালের বিনিয়োগ করা ৫০ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই এসেছে তাদের নিয়ন্ত্রিত ৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের পাবলিক মানি এভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে সিকিউরিটি ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১-এর ৫৬ বিধির পরিষ্কার লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিনিউজে এলআর গ্লোবালের নিজস্ব বিনিয়োগ মাত্র ১ কোটি টাকা। বাকি ৪৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে। প্রতিবেদনে ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ বেশি দামে কোন প্রতিষ্ঠান কতটি শেয়ার কিনেছে, তার বিবরণও দেয়া হয়েছে।

এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ৮০০ শেয়ার কিনেছে ১ কোটি টাকায়। ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৫ হাজার ১৬৬টি শেয়ার কিনেছে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। গ্রিনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৬ হাজার ৪১৪টি শেয়ার কিনেছে ৮ কোটি ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়।

এ ছাড়া, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামী মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৪ হাজার ৩৪৮টি শেয়ার কিনেছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এমবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৪ হাজার ৩৯৬টি শেয়ার কিনেছে ৫ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান ১৪ হাজার ৯৮টি শেয়ার কিনেছে ১৭ কোটি ৬২ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। এনসিসিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড-ওয়ান ৪ হাজার ৭৭৮টি শেয়ার কিনেছে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার টাকায়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বিডিনিউজকে একটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠান আখ্যায়িত করে বলা হয়, এই প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর দেড় থেকে আড়াই কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের বেতন অনিয়মিত। অথচ এমন একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে তিন মাসের ব্যবধানে ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের সঙ্গে ১২ হাজার ৪০০ টাকা প্রিমিয়াম যুক্ত হওয়া অস্বাভাবিক।

এতে বলা হয়, রিয়াজ ইসলাম অবশ্যই জানতেন যে তার বন্ধু আসিফ মাহমুদ বিডিনিউজের প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা দরে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর কাছে বিক্রি করেছেন। তারপরেও এলআর গ্লোবাল মিউচ্যুয়াল ফান্ডের টাকা অদক্ষতা ও প্রতারণার মাধ্যমে স্থানান্তর করেছে, যা শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতারণা। মানিলন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে এটি করা করা হয়ে থাকতে পারে।

এতে আরও বলা হয়, সম্পদ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে কী আছে সেটি এখানে বড় বিবেচনার বিষয় নয়, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য হলো, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অর্থ এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানে (পুঁজিবাজারে অ-তালিকাভুক্ত) বিনিয়োগ করা যায় কিনা? মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অর্থের প্রকৃত মালিক এর বিনিয়োগকারীরা। এই অর্থের মালিক এলআর গ্লোবাল নয়।

অনুসন্ধানের সময়ে বিডিনিউজের পাশাপাশি রংপুর ডিস্ট্রিলারিতেও একই ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে এলআর গ্লোবালের ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রমাণ পায় বিএসইসির তদন্ত কমিটি। রংপুর ডিস্টিলারির ৮০ লাখ শেয়ার তারা কিনেছে ১২.৫০ টাকা দরে। বিএসইসির তদন্ত কমিটি বলেছে, এই অনিয়মের পুরো দায় এলআর গ্লোবালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম, চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) রোনাল্ড ম্যাকি গোমেজ, হেড অফ লিগ্যাল অ্যান্ড কমপ্ল্যায়েন্স মনোয়ার হোসেনসহ বিনিয়োগ কমিটির সব সদস্যের।

কড়া পদক্ষেপের সুপারিশ্র: বিডিনিউজে এলআর গ্লোবালের ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের তদন্ত শেষে চারটি সুপারিশ করেছে বিএসইসির কমিটি। তারা বলেছে, বিডিনিউজ ও রংপুর ডিস্টিলারিতে বিনিয়োগ করায় এলআর গ্লোবালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম, চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) রোনাল্ড ম্যাকি গোমেজ, হেড অব লিগ্যাল অ্যান্ড কমপ্ল্যায়েন্স মনোয়ার হোসেনসহ বিনিয়াগ-সম্পর্কিত কমিটির সবাইকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত।

বিডিনিউজ ও রংপুর ডিস্টিলারিতে করা বিনিয়োগের অর্থ ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ফেরত আনার সুপারিশও করা হয়েছে। এ ছাড়া, তদন্ত কমিটি বলেছে, বিডিনিউজ ও রংপুর ডিস্টিলারি থেকে বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনার সব খরচ এলআর গ্লোবালকে বহন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তহবিল থেকে কোনো খরচ করা যাবে না।

তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের টাকা এলআর গ্লোবালের বতর্মান ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে রাখা নিরাপদ নয়। এজন্য সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১ এর ৫১ বিধি অনুযায়ী ফান্ডটিকে তারল্যে রূপান্তর করা যেতে পারে অথবা শেয়ারহোল্ডারদের চাহিদার ভিত্তিতে সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১ এর ৩১ বিধি অনুযায়ী সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি পরিবর্তন করা যেতে পারে।

এলআর গ্লোবাল থেকে রক্ষা পায়নি বিদেশী শেয়ারহোল্ডারও: দেশের অন্যতম সম্পদ ব্যবস্থাপক এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির বিদেশী মালিকদের গত আট বছর যাবত অন্ধকারে রেখেছে দেশি মালিক রিয়াজ ইসলাম। দিচ্ছে না কোন লভ্যাংশ বা কোন ধরণের তথ্য। বিষয়টি সুরাহা করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছে আবেদন করেছে বিদেশী মালিক গেভিন উইলসন।

বিএসইসিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কভিত্তিক প্রাইভেট বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এলআর ম্যানেজারস ইনভেস্টমেন্টস, এলপির পক্ষে বিএসইসির চেয়ারম্যান বরাবর এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন পার্টনার গেভিন উইলসন।

বিএসইসিকে দেওয়া চিঠিতে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির বিদেশী পার্টনার জানিয়েছেন, কোম্পানিটি ও সিআইও রিয়াজ ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের আইনী মামলা সম্পর্কে তারা অবগত। এই পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য সমস্যা সমাধানে তারা আলোচনা করতে চায়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, অংশীদার হিসেবে রিয়াজ ইসলামের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তারা পেয়েছে। এছাড়া তারা রিয়াজ ইসলামের বর্তমান কর্মকাণ্ডে অবগত এবং খুবই অখুশি। বিগত ৮ বছরে বিদেশীরা ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ মালিকানা সত্ত্বেও কোন লভ্যাংশ নেইনি বলে জানিয়েছে। যদিও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতি বছর লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এছাড়া রিয়াজ ইসলাম নিয়মিত বেতন ও বোনাস নিচ্ছে।

রিয়াজের বিষয়ে তাদের মতো বিভিন্ন ফান্ডের উদ্যোক্তারাও অবগত বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও তাদের কোম্পানিতে নেগেটিভ প্রভাব ফেলার আগেই বিষয়টি সমাধান করা উচিত বলে জানানো হয়েছে। তারা প্রতিটি উদ্যোক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মনোভাব নিয়ে আলোচনা করবে এবং রিয়াজ ইসলামকে পরিবর্তনের বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চাইবে। আস্থা অর্জন ও স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা পেতে তারা রিয়াজ ইসলামের মালিকানা বা শেয়ার কিনবে বলেও জানিয়েছে।

বিদেশী এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে বিনিয়োগকারী এবং অর্থনীতি, বাজার ও বিনিয়োগের সুযোগের উপর আস্থা রেখেছে বলে চিঠিতে জানানো হয়েছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রি দরকার।