আহসান আমীন : স্বাধীনতার ৫০ বছরে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন হয়েছে কতটুকু এ প্রশ্ন পুঁজিবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী সহ বাজার সংশ্লিষ্টদের। ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হলেও পুঁজিবাজার যেন ক্রমশ পিছু হঠেছে। শিল্পায়নে যেখানে মুখ্য ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে শিল্পায়নে ক্রমেই কমছে পুঁজিবাজারের ভূমিকা।

অথচ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ পুঁজিবাজার। একটি দেশের শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বজায় রাখতে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

কোনো দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। জনগণের ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একীভূত করে দেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব। বিনিয়োগের আরেকটি উপায় হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ, দেশের ভেতর বিনিয়োগ সক্রিয় থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ সহজে আকৃষ্ট হয়। বিনিয়োগের দুটি ক্ষেত্রেই পুঁজিবাজার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়। মোট দেশজ উৎপাদন ও মাথা পিছু আয়ের পর অর্থনীতিতেও পাকিস্তানের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে বাংলাদেশ। সবকিছুই হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ ও অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে গেলেও তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি পুঁজিবাজার।

পুঁজিবাজারে বড় বড় কোম্পানি যেমন তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য মালিকানার কিছু অংশ বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে, তেমনি কম-বেশি শেয়ার কিনে নিয়ে বৃহৎ কোনো কোম্পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকানার অংশ পায় সাধারণ জনগণ। পরবর্তী সময়ে কোম্পানি সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে উপার্জিত আয় লভ্যাংশ আকারে সাধারণ জনগণ পেয়ে থাকে। এভাবেই সাধারণ জনগণ তাদের জমানো অলস অর্থ দিয়ে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে নিজের ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত বিশ বছর ধরে প্রশংসনীয় সাফল্য ধরে রেখেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ সামাজিক বিভিন্ন সূচকেও উন্নতি করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা বর্ণনা হলেও এর প্রতিবিম্ব কি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দেখা যাচ্ছে? দেশের উন্নয়ন হলে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন হয় অথবা পুঁজিবাজারকে কাজে লাগিয়ে দেশে উন্নয়ন সম্ভব। আমরা কি সেটা করতে পেরেছি অথবা পারব? আমাদের পুঁজিবাজার নতুন নয়।

১৯৫৪ সালে শুরু হলেও মূলত গত দুই দশকে বিস্তার লাভ করেছে। পুঁজিবাজারের উত্তরোত্তর উন্নতি, অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতে এর ব্যাপকতা অনুধাবন করে ১৯৯৩ সালে ‘সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি) গঠিত হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে সংগ্রহ করে জনগণের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে নিশ্চিত করে সম্পদের কাম্য বণ্টনের প্রক্রিয়াই পুঁজিবাজার করে থাকে।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের পুঁজিবাজার কি সেই ভূমিকা রাখতে পেরেছে? আমরা জানি ২০১০-১১ সালের ভয়াবহ উত্থান-পতনের পর পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার খুবই ছোট। বর্তমানে আমাদের দেশে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন মাত্র ৯ শতাংশের মতো। যা আমাদের মতো অর্থনীতির দেশ ও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম।

১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ নামে যাত্রা, ১৯৬৪ সালে পরিবর্তিত নাম হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। বয়স বিবেচনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেয়েও পুরনো প্রতিষ্ঠান দেশের প্রধান এ পুঁজিবাজার। প্রত্যাশা ছিল বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হবে। পুঁজি সংগ্রহে হয়ে উঠবে উদ্যোক্তাদের মূল ভরসা।

কিন্তু দীর্ঘ ছয় দশকের পথচলায় সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি ডিএসই। নিজেকে বিকশিত করতে পারেনি পুরোপুরি কার্যকর ও গতিশীল একটি পুঁজিবাজার হিসেবে। বিশ্বের অনেক দেশেই অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে পুঁজিবাজার। এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোয়ও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাজার মূলধনের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

ডিএসই ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে বাংলাদেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। যদিও জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ভারতে ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, শ্রীলংকায় ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৯ দশমিক ২৯ শতাংশ, হংকংয়ে ১ হাজার ৩১১ দশমিক ১৪ শতাংশ ও চীনে ৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নয়নশীল দেশ হবে। দেশের মানুষের গড় আয় আরও বাড়বে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বিআরটিসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শিল্প বিপ্লব হবে। তবে কতটা উন্নতি হবে পুঁজিবাজারের এ প্রশ্ন খোদ বিনিয়োগকারীদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই সময় জিডিপি’র আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ।

পলিসিগত দুর্বলতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে না পারায় আমাদের পুঁজিবাজারের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন যেখানে ১০০ শতাংশের বেশি, সেখানে আমাদের দেশে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন মাত্র ৯ শতাংশের মতো।

৫০ বছর পর ২০২০ সালের হিসাবে রফতানি আয় বেড়ে ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। মাথাপিছু আয় ১৬ গুণ বেড়ে দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির আকার প্রায় ৪০০ গুণ বেড়ে ২৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের অর্থনীতি এভাবে এগিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রেখেছে শিল্পখাত। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) শিল্প খাতের অবদান ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন শিল্প খাতের অবদান বেড়ে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দেশের শিল্প খাত তরতর করে এগিয়ে গেলেও এ খাতের উন্নয়নে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না পুঁজিবাজার। অথচ শিল্প খাতের বিকাশে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখার কথা পুঁজিবাজারের। মূলত ব্যাংকঋণ সহজলভ্য হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি অর্থের জন্য ব্যাংকে ছুটছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এ কারণেই শিল্পায়নে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ফলস্বরূপ বাধাগ্রস্ত হয়েছে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন।

গত কয়েক বছরের ব্যাংকঋণ ও পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের তোলা অর্থের পরিমাণের তথ্য পর্যালোচনা করেও এই অর্থনীতিবিদের কথার মিল পাওয়া যায়। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দিন যত যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণের তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ তত কমছে।

সর্বশেষ পাঁচ বছর ব্যাংক থেকে যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে তার ১ শতাংশের কম। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বছরটিতে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছেন ৬৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের মাত্র দশমিক ৪২ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করেন উদ্যোক্তারা।

আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল দশমিক ৪৪ শতাংশ। বছরটিতে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসাবে উদ্যোক্তারা সংগ্রহ করেন এক লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে পুঁজিবাজার থেকে নেন ৬৫৫ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকঋণের দশমিক ৮৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করেন উদ্যোক্তারা। বছরটিতে এক লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণের বিপরীতে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৪২ কোটি টাকা।

এছাড়া ২০১৬ সালে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণের বিপরীতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের দশমিক ৭৯ শতাংশের সমান অর্থ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করেন উদ্যোক্তারা। ২০১৫ সালে ব্যাংকঋণের দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করেন তারা।

পাঁচ বছর ধরে পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ব্যাংকঋণের ১ শতাংশের কম হলেও ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২ শতাংশের ওপর ছিল। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ব্যাংকঋণের ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশের সমান। তারও আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালে ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১১ সালে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ২ শতাংশ ছিল।

শিল্পায়নের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার কারণে জিডিপির সঙ্গেও তাল মেলাতে পারছে না পুঁজিবাজার। ফলে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধনের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ছিল জিডিপির ৫০ দশমিক ৭০ শতাংশের সমান। ধারাবাহিকভাবে তা কমে মাত্র ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনে কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলেই পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা আছে। তবে এই আইনের বাস্তবায়নও দেখা যাচ্ছে না।

যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকার বেশি আছে এক হাজারের বেশি কোম্পানির। অথচ বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩৩৪টি।

আহসান আমীন, লেখক ও বাজার বিশ্লেষক