শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের বিতর্কিত কোম্পানি ফাইন ফুড লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগকারীদের জন্য মাত্র এক শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তবে কোম্পানির ঘোষিত ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের হতাশ করছে। কোম্পানিটি তালিকাভুক্তির পর থেকে নানা কান্ড কাহিনী ঘটিয়ে আলোচনায় আসেন।

বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করে বছরের পর বছর জেড ক্যাটাগরিতে অবস্থান। নানা গোজামিলে মুনাফা ফুলিয়ে অতিরঞ্জিত আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। তালিকাভুক্তির পর থেকে টানা স্টক ডিভিডেন্ডের নামে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে পরিচালকরা লুটপাট করতো। গত দুই বছর ধরে নামমাত্রা ডিভিডেন্ড দিয়ে ক্যাটাগরি ধরে রাখছে। আর বছর জুড়ে চলছে শেয়ার নিয়ে কারসাজি।

বছরজুড়ে অস্বাভাবিক মুনাফার উল্লম্ফনের পর শেষ প্রান্তিকে আবারও তলানিতে ফাইন ফুডের মুনাফা। কিন্তু এর মধ্যেই ৪০ টাকার শেয়ার ছুঁয়েছে ১০০ টাকার রেকর্ড। অর্থাৎ বছরের প্রথম দিনে যারা কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে আর্থিক প্রতিবেদনের গোলক ধাঁধায় তারা সর্বোচ্চ ১৫০ শতাংশ মুনাফা করেছে। কিন্তু মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) প্রকাশিত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে হঠাৎ করে মুনাফা তলানিতে নেমে আসায় আজ (বুধবার) কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ১২.৮০ শতাংশ।

অভিযোগ রয়েছে, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিত ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ ইস্যুতে কোম্পানিতে আধিপত্য হারানোর আশঙ্কায় হিসাব বছর শেষে নামমাত্র মুনাফা দেখাল বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। পাশাপাশি শেয়ার দর নিয়ে কারসাজি করতে বছরের শুরুতে আর্থিক মুনাফার উল্লম্ফন দেখিয়েছিল স্বল্পমূলধণী কোম্পানিটি।

শেয়ার কম থাকায় হঠাৎ মুনাফার উল্লম্ফন হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদে নিয়ন্ত্রন রাখতে হলে নতুন করে শেয়ার কিনতে হবে। তাই বছরের শেষ প্রান্তিকে নাম মাত্র মুনাফা ও ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে হাতে শেয়ার না থাকা নামমাত্র পরিচালকরা।

জানা যায়, বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে বা ৯ মাসে (অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই ’১৯ থেকে মার্চ ’২০) কোম্পানিটির মুনাফা ২ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। এসময় শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল ১.৪৪ টাকা। কিন্তু ২০১৯-২০ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ০.১৮ টাকা।

বছরান্তে শেয়ার সংখ্যার হিসাবে কোম্পানিটির মুনাফা দাঁড়ায় ২৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ সমাপ্ত বছরের জন্য ১ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ বছরের শেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। যা কোম্পানিটির গত ৩ বছরের সমন্বিত আয়ের যোগফলের তুলনায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা বেশি।

কোম্পানির ২০১৮-১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন সূত্রে জানায়, কোম্পানিটির আয়ের উৎস প্রধান মাছ চাষ। কিশোরগঞ্জে কোম্পানির মূল প্রজেক্ট। এ ছাড়া ময়মনসিংহে আরেকটি প্রকল্প রয়েছে। সব মিলিয়ে ফাইন ফুডসের প্রায় ২২১ বিঘা জমি রয়েছে। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় ছিল ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ হিসাব বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে কোম্পানির কোনো আয় না হলেও নিট মুনাফা এতটা কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। যদিও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মাছ ধরা ও বিক্রি নিষেধ ছিল না।

উদ্যেক্তাদের হাতে নামমাত্র শেয়ার: গতকাল ২৭ অক্টোবরের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান। এসময় বেশ কিছু কোম্পানি ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণ করলেও বেশকিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা শেয়ার ক্রয় করে নি।

ফাইন ফুডের পর্ষদে ৫ জন সদস্য থাকলেও চেয়ারম্যান সুজিত শাহ্ এর নিকট রয়েছে মাত্র ২০৬টি শেয়ার। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিপ এক্সিকিউটিভ অফিসার (এমডি ও সিইও) নজরুল ইসলামের নিকট ৭ লাখ ৬ হাজার ৮৩টি বা ৫.০৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিএসইসি’র শেয়ারধারণের নির্দেশণা পরিপালন না করা পর্ষদের অন্য তিন জনকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে রাখা হয়েছে।

বিনিয়োগকারী আনিস-উজ-জামান বলেন, মাত্র ১ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করায় মুনাফায় ছল চাতুরী করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। করোনা কালে লকডাউনের মধ্যেও দেশে ওষুধ খাত ও ভোগ্য পণ্য বিপনণে কোন সমস্যা হয়নি। বরং এ খাতগুলোর উদ্যোক্তারা সরকারের বাড়তি সহযোগিতা পেয়েছে। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতেও কোম্পানির মুনাফা কমে যাওয়া কারসাজির কারণ হতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।

এ বিষয়ে ফাইন ফুডের কোম্পানি সচিব সোহেল হোসেনের ব্যক্তিগত নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও তার মতামত পাওয়া যায় নি। ফাইন ফুডের অফিসের ফোনে ফোন দিলে অফিসে কেউ নাই বলে জানিয়ে দেন অপারেটর। এছাড়া প্রজেক্টের নাম্বারে ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণিত হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রভাবশালী পরিচালকদের খেয়াল-খুশির পর নির্ভর করে কোম্পানি মুনাফায় থাকবে না লোকসানে। যা হতে দেওয়া উচিত নয়।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান কমিশন অনেক সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। অবশ্যই তারা এটা নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিবে। মৎস্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত একটি কোম্পানির মুনাফায় হঠাৎ এমন পতন হওয়ার কোন কারণ নাই। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় এমন কিছুতে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য যদি প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়, তাহলে ওই কোম্পানির সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পুঁজিবাজারের বিকাশে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। তবে সেই কোম্পানির অবশ্যই আর্থিক স্বচ্ছতা ও ফান্ডামেন্টাল (মৌলিক) অবস্থা থাকতে হবে।

তাদের মতে, একের পর এক দুর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। ফলে আইপিওতে আসার সময় কোম্পানিগুলোর মুনাফায় বড় ধরনের উলম্ফন দেখা গেলেও তালিকাভুক্ত হওয়ার পর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দুর্বল ও গোজামিল তথ্য দিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিলে তা বাজারের জন্য ক্ষতিকর।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, গত দশ বছরে অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে যাদের বর্তমান আর্থিক চিত্র দেখলেই বোঝা যায় অধিকাংশ কোম্পানি প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাজারে এসেছে। মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম নিয়ে আসা কোম্পানির দাম মাত্র ৬ টাকায় নেমে যাওয়ার ঘটনাও আমরা দেখতে পারছি। এভাবে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে আজ পুঁজিবাজারের এমন দশা। সুত্র: দেশ প্রতিক্ষণ ডটকম