শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ ভেস্তে গেল। তারল্য সংকটের প্রভাবে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন রোধে বিনিয়োগ সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে সাড়া মেলেনি। বরং দিনের পর দিন পতনের মাত্রা বাড়ছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সুবিধা দিতে চাইলে স্বল্প মেয়াদ ও বিভিন্ন শর্তের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগটি ভেস্তে গেছে।

একটি ব্যাংক ছাড়া আর কেউ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়নি। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সাময়িক তারল্য সুবিধার বিষয়টিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা ‘আইওয়াশ’ হিসেবে দেখছেন। তারল্য সংকট, বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতার কারণে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারির পর থেকে পুঁজিবাজারে টানা দরপতন চলছে।

এরই প্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে ব্যাংকগুলোকে সাময়িক তারল্য সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি হলেও একমাত্র সিটি ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংক ওই সুবিধা নেয়নি। সার্কুলার জারির তিন মাসের মধ্যে আবেদনের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আজ শেষ হতে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সুবিধা নিতে না চাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে ওই তহবিলের মেয়াদ। ট্রেজারি বিল বা বন্ড রেপোর মাধ্যমে নেওয়া ওই তহবিলের মেয়াদ হবে ২৮ দিন এবং তহবিল ব্যবহারের সাফল্যের ওপর তা সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত রাখা যাবে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পুঁজিবাজারের যে পরিস্থিতি তাতে তহবিল ব্যবহারের পর যে উন্নতি হবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই। বরং বাজার আরও খারাপ হতে পারে। আদতে তাই হয়েছে।

গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৪৬৪ পয়েন্ট বা সাড়ে ৯ শতাংশ কমেছে। এর মানে হচ্ছে সিটি ব্যাংক ওই সুবিধার আওতায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ করেছে, তাতে ইতিমধ্যেই লোকসান দেখা দিয়েছে। এ সময় মৌলভিত্তির অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে। এ সময় স্কয়ার ফার্মা হারিয়েছে ২৩ শতাংশ দর। বিএটি বাংলাদেশের শেয়ার দর কমেছে ১৮ শতাংশ। বাজার মূলধনে শীর্ষ কোম্পানি গ্রামীণফোন হারিয়েছে ১৯ শতাংশ দর। গত তিন মাসে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে ২৭ শতাংশ। এ সময় বীমা ছাড়া অন্য সব শেয়ারের দরই কমেছে।

সার্কুলারে বলা হয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোকে ট্রেজারি বন্ড বা বিলের রেপো মূল্যের ৫ শতাংশ মার্জিন হিসেবে রেখে তারল্য সুবিধা দেওয়া হবে, যার সুদহার হবে ৬ শতাংশ। বর্তমানে ঝুঁকিমুক্ত ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের ওপর প্রায় ৮ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে থাকে সরকার। এছাড়া ৯১ দিন ও ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলে সুদহার হচ্ছে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ পুঁজিবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের যে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিও তহবিল ব্যবহারে ব্যাংকগুলোকে নিরুৎসাহিত করছে। তাই ঝুঁকিমুক্ত ট্রেজারি বিল জামানত রেখে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ৬ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিতে চাইছে না ব্যাংকগুলো।

ট্রেজারি বন্ড বা বিল রেপোর মাধ্যমে ওই তারল্য ব্যবহারে ব্যাংকগুলোকে আলাদা বিও (বেনিফিসিয়ারি ওনার্স) হিসাব খুলতে হবে। এ ছাড়া নগদ রেপোর অর্থ পরিশোধের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখে সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিজের বাজার মূল্য আদায়যোগ্য অর্থ অপেক্ষা কম হলে তা ইতিপূর্বে রাখা মার্জিন থেকে সমন্বয় করা হবে। সমন্বয়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে ব্যাংক তা দিতে বাধ্য থাকবে। এখন এই ঋণ নিয়ে সিটি ব্যাংক যদি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগে লোকসান করে, তাহলে ব্যাংকটিকে এখন নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ দিতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাময়িক তারল্য সুবিধার পরিবর্তে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সহায়তার দাবি জানিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারিগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের অংশ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়ে গত ৪ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। এ ধরনের তহবিল গঠনের বিষয়ে মতামতের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (এসইসি) পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

পুঁজিবাজারের সহযোগিতায় ৬ বছরের জন্য ওই তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা পুঁজিবাজারের সব মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রথম বছর সুদ চার্জ না করার আহবান করা হয়েছে। এই টাকার বিপরীতে দ্বিতীয় বছর থেকে ৩ শতাংশ হারে সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর চতুর্থ বছর থেকে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হবে।

প্রসঙ্গত, ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য সংকট ও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রভাবে ২০১৮ সাল থেকে পুঁজিবাজারে দরপতন চলছে। ২০১৮ সাল থেকে গত ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময় সূচকটি ৬২৪৪ থেকে ৪৪৫৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে। আর ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৮৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।