শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: জুন ক্লোজিং কোম্পানিগুলো ২০১৮ সালের আর্থিক হিসাব প্রকাশ শেষে বার্ষিক সাধারন সভা (এজিএম) করেছে। তবে কিছু কিছু কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য আতঙ্ক হিসাবে কাজ করছে এজিএম পার্টি। যেসব কোম্পানি ক্রমাগত নিচের দিকে ও দুর্নীতি পরায়ণ সেসব কোম্পানির এজিএমে এই পার্টির উৎপাত বেশি লক্ষ্য করা যায়।

তবে অন্যসব কোম্পানিও এর বাইরে থাকে না। প্রত্যেকটি কোম্পানি তাদের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে সামর্থ্য অনুযায়ি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে। আর এরই মধ্যে ২০১৮ সালের জন্য কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। যা এজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনের মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে।

কিন্তু অনেক সময় একটি কোম্পানি ভালো আয় করা সত্বেও পরিচালকরা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে তা থেকে বঞ্চিত করে বিনিয়োগকারীদেরকে। আবার তাদের দুর্ণীতির কারণে বিলীনও হয়ে যায় অনেক কোম্পানি। এদিকে বর্তমানে এমন পরিস্থিতি চলে এসেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ না চাইলেও এজিএম পার্টি নিজেরাই চাঁদা নির্ধারণ করে দায়িত্ব পালন করে।

যার পরিমাণ সাধারণত ৫-১০ লাখ টাকা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নিতে পারে না তাদের দুর্বলতা বা অনৈতিকতা প্রকাশ হওয়ার ভয়ে। এছাড়া এজিএমে পার্টির হাত থেকে মানসম্মান রক্ষার জন্যও অনেকে আবার বাধ্য হয় তাদের চাঁদা দিতে।

বিভিন্ন কারনে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানির এজিএমে এই পার্টির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কোম্পানি অনেক সময় নিজেরা তাদের নিয়োগ দেয়। আবার অনেক কোম্পানিতে পার্টিগুলো জোরপূর্বক প্রবেশ করে। যেসকল পরিচালক নিয়োগ দেয়, তাদের অধিকাংশ পরিচালক দুর্ণীতির সাথে জড়িত থাকে। আর এই অপকর্ম আড়াল করতেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

তবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে কোন ক্ষেত্রেই তাদের প্রভাব লক্ষ করা যায় না। এসব কোম্পানির কর্তৃপক্ষের সততার কারনেই এজিএম পার্টি কিছু করতে পারে না বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানি আইন অনুযায়ি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোকে প্রত্যেক বছর এজিএম করতে হয়। যাতে করে শেয়ারহোল্ডাররা তাদের মতামত তুলে ধরতে পারেন।

যেখানে তারা কোম্পানির আলোচ্য বিষয়সমুহ ইতিবাচক মনে হলে পাশ, অন্যথায় না করতে পারেন। কিন্তু ঘটে যাওয়া কোম্পানিগুলোর এজিএমে গিয়ে দেখা যায় বিনিয়োগকারীরা কোনো ধরনের মতামত দেওয়ার মতো সুযোগ পান না। কোম্পানির সমস্ত বিষয়ে মতামত দেন কোম্পানিরই ভাড়া করা কিছু লোক। যাদেরকে এজিএম পার্টি হিসাবে ডাকা হয়। বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় প্রত্যেকটি কোম্পানির এজিএমে একই লোকের উপস্থিতি। সাধারন শেয়ারহোল্ডাররা তাদের চেনেন না।

কিন্তু তারাই দেখা যায় সব বিষয়ে মতামত পোষণ করেন। যার ফলে সাধারন শেয়ারহোল্ডাররা কোনো কিছুই করতে পারে না। আর কেউ যদি কিছু বলতে চায় তাহলে তাকে মার খেতে হয়। শেয়ারহোল্ডাররা অভিযোগ করে বলেন, এভাবে আর কতোদিন অধিকার বঞ্চিত থাকব। তাই আবার এজিএম পার্টির খপ্পরে শেয়ারহোল্ডাররা যেন অধিকার বঞ্চিত না হয় সেদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজর দেওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, বিশৃঙ্খলা এড়াতে এজিএমে কোন ধরনের গিফট বা আপ্যায়নের ব্যবস্থা না করার জন্য এরই মধ্যে দুই দফায় নির্দেশনা জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে এজিএম পার্টি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও সে বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং লিমিটেড প্রহসনের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করেছে। এমনটাই অভিযোগ ওঠে কোম্পানির বিরুদ্ধে। আজ রাজধানীর ফারস হোটেলে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। কোম্পানির এজিএমে গিয়ে দেখা গেলো ভয়ানক সব দৃশ্য। ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১১টায় সভাটি অনুষ্ঠিত হওবার কথা থাকলেও তবে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ অনুযায়ী তা শুরু হয় ভাড়াটে মাস্তান এবং দালালদের নিয়ে। প্রথানুযায়ী নোটিশ পড়াসহ কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই শুরু হবার সাথে সাথে পাস পাস বলে মাস্তান ও দালালরা চিৎকার করতে থাকে।

পুলিশ রেখে এজিএমের নামে বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হালাল করছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানী। অবিশ্বাস্য ও নজিরবীহিন এক এজিএমের চিত্র উল্লেখিত অভিযোগে ফুটে উঠেছে। ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফারস হোটেল এন্ড রিসোর্টে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিঃ এর ২৩তম বার্ষিক সাধারণ সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১১টায় সভাটি অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ অনুযায়ী তা শুরু হয় ভাড়াটে মাস্তান এবং দালালদের নিয়ে। প্রথানুযায়ী নোটিশ পড়াসহ কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই শুরু হবার সাথে সাথে পাস পাস বলে মাস্তান ও দালালরা চিৎকার করতে থাকে।

এ সময় কয়েকজন সাধারণ বিনিয়োগকারী প্রতিবাদ করলে মাস্তান ও দালালরা তাদের তাড়া করে। অনন্নোপায় হয়ে তারা নিচে এসে হোটেল লবিতে আশ্রয় নেয়। এখানেও পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে পুলিশ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সাংবাদিক পরিচয় জেনে অসংখ্য বিনিয়োগকারী এ প্রতিবেদককে ঘিরে ধরে তাদের অভিযোগ জানাতে থাকেন। এর মধ্যে থেকে কয়েক জনের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশ শেয়ার ইনভেস্টর্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সেলিম রেজা। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন দেশে এমন এজিএম প্রত্যাশা করিনি। বহিরাগত দালাল এনে সকল বিধি-বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এজিএমের নামে মহা প্রতারণার নাটক মঞ্চস্থ করে এই কোম্পানীটি। বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে এখন তা হালাল করার পথ পরিষ্কার করতে শেয়ারহোল্ডারদের কোন কথা বলতে দেয়নি। তিনি বলেন, এই কোম্পানীগুলো খুবই শক্তিশালী। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ইতোপূর্বে সেলিম চৌধুরীকে কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ নেতা সেলিম চৌধুরী বলেন, এ কোম্পানীটি বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হজম করেছে। তাদের লুটপাটের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলো শেয়ারহোল্ডারা। এহেন অবস্থায় আঁচ করতে পেরে কোম্পানীটি ভাড়াটে মাস্তান এনে এজিএমের নামে প্রহসন করেছে। আমরা সবাই এসেছি। কিন্তু অপমানজনকভাবে ফিরে যাচ্ছি। সরকারকে অনুরোধ করে বলবো, শেয়ারহোল্ডাদের কোটি কোটি টাকা লুটপুাটের অপরাধে এ কোম্পানীটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এমন এজিএম আমরা দেখিনি। নোটিশ পাঠ পর্যন্ত হয়নি। এরা আইন বিরোধী কাজ করেছে। পূর্বের ম্যানেজমেন্ট লুটপাট করেছে। বর্তমানেও কোটি কোটি টাকা লুটপাটের পাঁয়তারা করে সফলকাম হচ্ছে। এহেন অবস্থান অবসান কামনা করেন কাজী আব্দুর রাজ্জাক।

সৈয়দ হাবীব হায়দার বাবু বলেন, একজন শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আমি এ কোম্পানীর অনিয়ম দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ ছিলাম। এসেছি প্রতিবাদ করতে কিন্তু পারলাম না।

শিরীন আখতারের প্রশ্ন, এজিএমে ঢুকতে হলে রেজিস্টেশন করতে হয়। কিন্তু বহিরাগতরা কিভাবে ঢুকলো। অন্য শেয়ারহোল্ডারদের বক্তব্য হলো এজিএম করলে কোম্পানীটির দুর্নীতির চিত্র সবার সামনে চলে আসতো। এই কারণে তারা জবাবদিহিতার ভয়ে এজিএম করতে পারেনি।

এ বিষয়ে কোম্পানী সচিব রাহাত মাহমুদের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার অফিস নাম্বার ও মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে নাদিয়া নামে একজন জানালেন, ভাইয়া এখন চেয়ারে নেই। এছাড়া এই প্রতিবেদক রাহাত মাহমুদের মোবাইলে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে এসএমএসও পাঠান। তার কাছ থেকে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন জবাব আসেনি।

এদিকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন’১৯) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা কমেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ০.০১ টাকা। যা আগের বছর একই সময় শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) ছিল ০.০৮ টাকা।

এদিকে ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন’১৯) শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় ( ইপিএস) হয়েছে ০.১০ টাকা। যা আগের বছর একই সময় শেয়ার প্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) ছিল ০.৫২ টাকা। এছাড়া শেয়ার প্রতি সমন্বিত নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ০.০৩ টাকা (নেগেটিভ) এবং ৩০ জুন, ২০১৯ পর্যন্ত শেয়ার প্রতি সমন্বিত সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) হয়েছে ১৩.৪৬ টাকা।