শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: লুণ্ঠনের শিকার হয়ে সংকটের মধ্যে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) শেয়ারদর কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। শেয়ারহোল্ডারা রয়েছেন পুঁজি নিয়ে দু:শ্চিন্তায়। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল)। নানা সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানটি ফেরত দিতে পারছে না আমানতকারীদের অর্থ। আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটির দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন বিপুলসংখ্যক আমানতকারী। এদের বেশির ভাগই ফিরছে শূন্য হাতে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নজিরবিহীন ঋণ কেলেঙ্কারি আর গ্রাহকের আমানতের টাকা লোপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ছাড়া আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে আইএলএফএসএলে নিরপেক্ষ পর্ষদ বসানো হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নানা দুর্নীতির কারণে ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান এফআইসিএসডির কয়েক হাজার বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। যেসব ব্যক্তি অর্থ পাচার ও লুট করে তাদের সাজার আওতায় আনতে সময় লাগে। আবার আইনের ফাঁক গলে অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। এ জন্য একই অপরাধ বারবার ঘটতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে।’

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এজিএম হাসান মোহাম্মদ তারেক বাংলদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে (এফআইসিএসডি) লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি তার অভিযোগে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউর রহমান এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান জসিম উদ্দিন বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড এবং আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের নামে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণের অর্থ ছাড় করেছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত মো. মশিউর রহমান এবং জসিম উদ্দিনের সিদ্ধান্তে রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড এবং আনান কেমিক্যাল লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর হেড অফিসে দুটি সুসজ্জিত কক্ষও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় আইএলএফএসএল এর গাড়ি রেপটাইলস ফার্ম, আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তবে বিষয়টি সহজ নয়। আসলটা ফেরত পেলেও সুদ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত মো. মশিউর রহমান এবং জসিম উদ্দিন ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বড় অঙ্কের অর্থ সিটি ব্যাংকে তাদের বেতন হিসেবে স্থানান্তর করেন। মো. মশিউর রহমান এবং জসিম উদ্দিন আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধের পরিবর্তে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন নতুন প্রকল্পে ঋণ প্রদানে বেশি উৎসাহিত ছিলেন।

প্রতিষ্ঠানটি তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও ২০২৩ সালে আগের তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত প্রশাসনিক খরচ দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে গাড়ি মেরামত এবং জ্বালানি তেল বাবদ খরচ বেশি দেখানো হচ্ছে। এদিকে প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেয়। তাদের কার্যক্রমে ত্রুটি থাকলে, তা দেখভালের জন্য পর্যবেক্ষক দেওয়া হয়। এরপরও কেউ অপরাধ করলে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।’

এদিকে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বিপরীতে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২ টাকা ৭৬ পয়সা। যা ২০২২ সালের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২ টাকা ১১ পয়সা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান বেড়েছে ৬৫ পয়সা।

২০২২ সালের তুলনায় ১৪ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৫৯ টাকা লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি ২২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৬ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে লোকসান ছিল ৪৬ কোটি ৮০ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ টাকা। টানা চার বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার সংখ্যা ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৬টি।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগকারীদের ২০২২ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ২০২২ হিসাববছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার এমন ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ।

এদিকে ২০২১ হিসাববছরেও কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। উল্লিখিত সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৯ টাকা ২৬ পয়সা (লোকসান)। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি নেট সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১৫৪ টাকা ১৯ পয়সা (লোকসান)। এ ছাড়া এ হিসাববছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ৭ টাকা ৪ পয়সা (লোকসান)।

আইএলএফএসএলর কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন ‘তিনি এ প্রতিষ্ঠানে নতুন এসেছেন। অনেক বিষয় তিনি এখন পর্যন্ত ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন তনি তা জানেন। বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন বলে তিনি জানান।’

তিনি বলেন ‘আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক। আমরা তা আদায়ের চেষ্টা করছি’। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রতিষ্ঠান আগের মতো সুনামে ফিরে আসতে পারবে বলে তিনি জানান।