শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে লেনদেনে গতি ফিরলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। এ কারণে বাজারের সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধির পরও বাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ৫ হাজার ৩৫৫ জন বিনিয়োগকারী তাঁদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বাজার ছেড়েছেন। পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার ধারণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্য থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৩৯৫। সপ্তাহ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫০টিতে। অর্থাৎ সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ৫ হাজার ৩৫৫ জন বিনিয়োগকারী তাঁদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে সপ্তাহের শেষ দিনে এসে শেয়ারশূন্য বিও হিসাব গত সপ্তাহের চেয়ে বেড়ে গেছে।

শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কমেছে শেয়ারসহ বিও হিসাবের সংখ্যা। গত সপ্তাহ শেষে পুঁজিবাজারে সক্রিয় তথা শেয়ারসহ বিও হিসাবের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৫। আগের সপ্তাহে শেয়ারসহ বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৭। শেয়ারবাজারে যেসব বিও হিসাবে শেয়ার থাকে সেগুলোকেই মূলত সক্রিয় বিও হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সাধারণত দেখা যায়, পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় থাকলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে বাজারে দরপতন অব্যাহত থাকায় শেয়ারবাজার ছেড়ে যাওয়া বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি গত সপ্তাহে লেনদেন ও সূচক বাড়লেও বিনিয়োগকারীদের বাজার ছাড়ার এই প্রবণতায় ছেদ পড়েনি। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নানা কারণে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম আস্থার সংকট, কারসাজির ভয়, দীর্ঘদিন ধরে বাজারে মন্দাবস্থা, ব্যাংকে আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়া।

এদিকে গত আট বছরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী কমেছে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার বা ৪৫ শতাংশ। পুঁজিবাজার থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে নেই আইনের কঠোর প্রয়োগ। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা আসেনি। প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় পুঁজিবাজার নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারের গতি বাড়াতে রাজস্ব ছাড়সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আদায় কমে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় এখন পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খসড়া বাজেট প্রস্তাবে উল্লেযোগ্য কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পুঁজিবাজারে বিশেষ সুবিধায় অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা) বিনিয়োগের পক্ষে এনবিআর থাকলেও বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আর তাই এ পদক্ষেপ আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

পুঁজিবাজার গতিশীল করতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যেন ৫০ হাজার টাকা লভ্যাংশের ওপর কর প্রত্যাহার করা হয়। তাদের এই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরে। পাশাপাশি বাজার চাঙা করতে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট করহারের ব্যবধান বৃদ্ধি, ট্রেকের লেনদেনের বিপরীতে উৎসে কর হ্রাস এবং বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করতে সুদ আয়ের ওপর কর প্রত্যাহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান বলেন, ‘পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে বাজারে নতুন কোম্পানি আনা প্রয়োজন। তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট করহারের ব্যবধান বাড়ানোর মাধ্যমে সেটি করা সম্ভব। এ ছাড়া স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে প্রতি লাখ টাকা লেনদেনে ৫০ টাকা উৎসে কর আদায় করা হয়।

এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ পড়ছে, যা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১৩ টাকা, পাকিস্তানে ২০ টাকা এবং হংকংয়ে ২ টাকা ৭০ পয়সা আদায় করা হয়। লভ্যাংশকে করমুক্ত আয় হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। বর্তমানে লভ্যাংশের ওপর দ্বৈত হারে কর আদায় করা হচ্ছে।

প্রস্তাবে সব ধরনের বন্ড ও ডিবেঞ্চার পুঁজিবাজার এক্সপোজারের বাইরে রাখার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মিউচুয়াল ফান্ডকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে পুঁজিবাজারকে এক্সপোজারের বাইরে রাখতে হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে নিজ সাবসিডিয়ারিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সিঙ্গেল বোরোয়ার এক্সপোজার রিল্যাক্স করতে হবে। আরও বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে ২ শতাংশ সাধারণ সঞ্চিতি রাখতে হয়। অথচ অন্য সব ঋণের ক্ষেত্রে সেটি ১ শতাংশ।

তাই ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হয় বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুদের হার বেশি ধরা হয়। এ বিষয়টি গুরুত্ব-সহকারে বিবেচনা করে অন্যান্য ঋণের মতো সাধারণ সঞ্চিতি ১ শতাংশ ধরা হলে বাজারে অর্থের জোগান বাড়তে সাহায্য করবে। সমন্বিত পুঁজিবাজার এক্সপোজার হিসাব রিপোর্টিং স্থগিত করা প্রয়োজন।

পুঁজিবাজারের আকার বৃদ্ধিতে এটি প্রতিবন্ধকতা। ভালো প্রতিষ্ঠান বা যারা ভালো ব্যবসা করেন তারা সহজে যেকোনো পরিমাণ ঋণ পান। তারা জামানত দিয়ে সহজেই ঋণ পেয়ে যান বলে পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করেন না। বড় বা ভালোমানের প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত না হলে পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়বে না। তাই ওই সব প্রতিষ্ঠানের ঋণ, মূলধন বা ব্যবসার আকৃতির ওপর তালিকাভুক্তির একটি কাঠামো নির্ধারণ করা যেতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআর বাজেট প্রস্তুতি কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের জন্য বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দায়িত্ব রয়েছে এনবিআরের ওপর।

তাই রাজস্ব ছাড়সংক্রান্ত বেশির ভাগ প্রস্তারেরই বিরোধিতা করছে এনবিআর। তবে পুঁজিবাজারে বিশেষ সুবিধায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু আইএমএফ থেকে এই প্রস্তাব মেনে না নেওয়ার চাপ আছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য পুঁজিবাজারে গতি আনতে বিশেষ সুবিধায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বেশির ভাগ উন্নত দেশে পুঁজিবাজার থেকে অর্থনীতির মূল ধারায় যোগ হয় বড় অঙ্কের অর্থ। ওই সব দেশের সরকার আপৎকালীন শেয়ারবাজার থেকে অর্থ নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র কিছুটা অন্য রকম। গত এক যুগে হাজার হাজার কোটি টাকার কারসাজি করা হলেও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। দীর্ঘ সময়েও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসেনি।’

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে ২০১৫ সালের জুন মাসের শেষে বিনিয়োগকারী ছিল ৩১ লাখ ৯৫ হাজার। বর্তমানে বিনিয়োগকারী ১৭ লাখ ৫৬ হাজার। পুঁজিবাজারের এ পতনের জন্য বিনিয়োগকারীদের ‘আস্থাহীনতা ও আতঙ্কিত’ হওয়া বড় কারণ। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বাজারে ছাড়ছেন। এ বাজারে গতি আনতে সরকারকে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বাজেটের মতো বড় আয়োজনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। পুঁজিবাজারে গতি এলে সমগ্র অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগকারীরা কেন বাজার ছাড়ছেন এটা রেগুলেটরদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ চিহ্নিত করতে হবে এবং সমাধানে কাজ করতে হবে। শেয়ারগুলোর পেছনে টাকার সরবরাহ কমে গেছে। বিশ্লেষকদের সুপারিশগুলো বিবেচনা করে বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশি বিনিয়োগকারীরা না এলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, এনবিআর খতিয়ে দেখছে, পুঁজিবাজারে কর ছাড়ের যৌক্তিকতা কতটুকু। কর ছাড়ের মাধ্যমে সবাই শক্তিশালী হতে চায়। কিন্তু দেশকে শক্তিশালী করতে হলে কর আদায়ের বিকল্প নেই।

পুঁজিবাজারের শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও সবাই যে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, এমনটি নয়। যাঁরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন তাঁদের অর্থ বিও হিসাবেই থাকছে। নতুন করে তাঁরা বাজারে সক্রিয় হচ্ছেন না।