শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: এখন থেকে ২৩ বছর আগে জেএইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩২ হাজারেরও বেশি ভুয়া শেয়ার বিক্রি করে। ভুয়া শেয়ার বাজারে ঢুকে পড়ায় ওই সময় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানিটির শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ ঘোষণা করে। এ ঘটনায় ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করে।

অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার ১৫ কর্মকর্তা নির্ভুল প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর ১৬তম তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে বলা হয়, ওই সময় জেএইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পুঁজিবাজারে তাদের অনুমোদিত শেয়ারের চেয়ে ৩২ হাজারেরও বেশি ভুয়া শেয়ার বিক্রি করে।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জেএইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি টাকা, যা ১০ লাখ শেয়ারে বিভক্ত। ইস্যুকৃত ও পরিশোধিত মূলধন ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ারে বিভক্ত। প্রতিষ্ঠানটির মোট ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ারের মধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার শেয়ার হস্তান্তরযোগ্য। অবশিষ্ট ১ লাখ ৬৫ হাজার শেয়ার হস্তান্তরযোগ্য নয়।

কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালের ২৪ ও ২৫ মার্চ শেয়ার লেনদেনের বিপরীতে কোম্পানিটির ১ লাখ ৯৭ হাজার ২০০টি শেয়ার হস্তান্তরের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ দুটির ক্লিয়ারিং হাউসে জমা পড়ে। এতে হস্তান্তরযোগ্য শেয়ারের চেয়ে ৩২ হাজার শেয়ার অতিরিক্ত জমা হয়। ওই সময় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৫০টি ভুয়া শেয়ার বাজারে আসে।

ফলে ডিএসই ও সিএসই ওই কোম্পানির শেয়ার বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে জেএইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ৬৮৪টি বরাদ্দপত্র বাতিল করে। প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।

সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া পিবিআই পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৯ সালে জেএইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড অনুমোদিত শেয়ারের চেয়ে বেশি শেয়ার এবং একই নম্বরের একাধিক শেয়ার জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বাজারে ছাড়ে। শেয়ার বিক্রির অর্থের আংশিক ব্যাংকে জমা দিলেও বাকি অর্থ জমা দেয়নি। এ ঘটনায় ভুয়া শেয়ার বিক্রি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে সন্তোষজনক চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে এত দেরিতে চার্জশিট দেওয়াকে অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মন্তব্য করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালের মামলায় ২০২২ সালে এসে চার্জশিট দিয়েছে, এটা তো অস্বাভাবিক ঘটনা। তদন্তে এত দেরি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক হতে হবে। এ মামলার বিচারকাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।

এক মামলায় রেকর্ড ১৬ তদন্ত কর্মকর্তা: ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে মামলার পর এসআই আ. সামাদ প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তদন্ত শুরু করেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আ. কাহার আকন্দ দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পান। তিনি জানতে পারেন, কোম্পানিটির চেয়ারম্যান দিলওয়ার জাহান নাজমা, পরিচালক সুব্রত দত্ত, মাহবুবুর রহমান সেলিম, জিল্লুর রহমান খসরু ও মো. রইসুল আলম। এরপর তিনি বদলি হয়ে যান। তৃতীয় ও চতুর্থ তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখযোগ্য কিছু পাননি।

পঞ্চম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ তদন্তে দেখতে পান, কোম্পানির শেয়ার সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা করতেন আসামি সুব্রত দত্ত। তিনি এ মামলার মূল নায়ক। ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি বদলি হওয়ার পর ষষ্ঠ ও সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখযোগ্য কিছু করেননি।

সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক হাবিবুর রহমান অষ্টম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে কিছু কাগজপত্র আলামত হিসেবে জব্দ করেন। ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি বদলি হলে পুলিশ পরিদর্শক এরশাদ আলী নবম তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পান। তিনি জানতে পারেন, মামলার বাদী আহমেদ হোসেন পদত্যাগ করে কানাডায় চলে গেছেন। ১০ম ও ১১তম তদন্তকারী কর্মকর্তার উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম ছিল না।

মামলার ১২তম তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন তদন্তে উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালের ৮ আগস্ট আসামি এমএ মালেক মারা গেছেন। মামলার ১৩তম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এসআই কুদ্দুসুর রহমান ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর আসামি রাগীব আহসান ও সৈয়দ আফসারকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠান। ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি সুব্রত দত্তসহ চারজনকে অভিযুক্ত ও আটজনকে অব্যাহতি দিয়ে চার্জশিট দাখিল করেন। এ মামলায় আদালত চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

এ অভিযোগ গঠনের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যান আসামি রাগীব, আফসার ও দেবব্রত। ২০১৮ সালের ১৫ মে উচ্চ আদালত অভিযোগ গঠনের আদেশ বাতিল করে দেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। মামলার ১৪তম তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিঝিল থানার এসআই আ. জলিল একমাত্র সুব্রত দত্তকে অভিযুক্ত ও ১২ জনকে অব্যাহতি দিয়ে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন।

বাদী নারাজি দিলে আদালত ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ারুল ইসলাম ১৫তম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তদন্ত শুরু করেন। তিনি বদলি হয়ে গেলে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম সর্বশেষ ও ১৬তম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

চার্জশিটে উল্লিখিত আসামিরা: জেএইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক সুব্রত দত্ত, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান সেলিম, পরিচালক দিলওয়ার জাহান নাজমা, পরিচালক জিল্লুর রহমান খসরু ও পরিচালক মো. রইসুল আলম। এদের মধ্যে আসামি সুব্রত দত্ত শুরু থেকেই পলাতক।

৮ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ: অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় আটজনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। তারা হলেন—মালেক অ্যান্ড কোং-এর হিসাবরক্ষক এমএ মালেক, রেজাউর রহমান সিনহা অজয়, শোয়েব আহম্মেদ মাসুদ, স্বদেশ অঞ্জন সাহা, দেবব্রত দত্ত, মো. রাগীব আহসান ও সৈয়দ আফসার হোসেন। তদন্ত শেষে পিবিআই আসামি সুব্রত, মাহবুবুর, নাজমা, জিল্লুর রহমান ও রইসুল আলমের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪২০/৪০৬/৪০৩/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

এসব ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। দুই সাক্ষী কানাডায়, অপর দুই সাক্ষীর খোঁজ মেলেনি: মামলার মোট ২৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ জন সাক্ষী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। একজন মামলার রেকর্ডিং অফিসার ও পুলিশের এসআই মনিরুল ইসলাম। দুই সাক্ষী নিরঞ্জর কুমার রায় ও এম ইজাজ মনসুর বর্তমানে কানাডায়।

এ ছাড়া সাক্ষী রফিকুর রহমান ও খন্দকবার আসাদুল্লাহকে পাওয়া যায়নি বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার বাদী আহমেদ হোসেনও বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তার পরিবর্তে বর্তমানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রহমান চৌধুরী বাদী হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। বর্তমান বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সুত্র: কালবেলা