শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। তবে সূচকের পতনের দিনেও হাতবদল হয়েছে ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকার শেয়ার, যা ২০১০ সালের মহাধসের পর সপ্তম সর্বোচ্চ লেনদেন। ২০২০ সালে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর পর গত বছরের আগস্টের তিনটি এবং সেপ্টেম্বরের তিনটি কর্মদিবসে এর চেয়ে বেশি লেনদেন হয়। এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন।

আজ বেলা একটা পর্যন্ত লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই, সূচক তখন পর্যন্ত বেড়েছে ৭০ পয়েন্ট। শুরুতেই ৫০ পয়েন্ট বেড়ে যাওয়ার পর এই উত্থানে গত ৯ মে’র অবস্থানকে ছাড়িয়ে যায় কি না, এমন অপেক্ষার মধ্যে হঠাৎ নিম্নমুখী প্রবণতা। কেবল ৫০ মিনিটে ৭৪ পয়েন্টের পতন দেখল বিনিয়োগকারীরা। সপ্তাহের তৃতীয় কর্মদিবসে এই চিত্রই বলে দেয় উত্থান পর্বেও দেশের পুঁজিবাজার স্বাভাবিক আচরণ করছে না। এই পতনের মূল কারণ অবিশ্বাস্য উত্থানে থাকা ওরিয়ন গ্রুপের একটি কোম্পানির দরপতন।

বিনিয়োগকারীরা যখন রুদ্ধশ্বাসে সূচকের এই নব অভিযাত্রা প্রত্যক্ষ করছিল, ঠিক সেই সময়ে আচমকা শুরু হয় জুয়াড়ি শেয়ারগুলোতে বিক্রির হুলস্থুল। সঙ্গে সঙ্গে সূচক উল্টোপথে দৌড় শুরু করে। মাত্র ৫০ মিনিটের দৌড়ানিতেই ৭০ পয়েন্টের ঊর্ধ্বমুখী সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৪ পয়েন্টের বেশি পতনে চলে যায়। সূচকের এমন অবিশ্বাস্য পতনে বিনিয়োগকারীরা বিহ্বল হয়ে পড়েন। তাদের মনে ফের অজানা আতঙ্ক ভর করে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পতনের এই অবিশ্বাস্য পতনের পেছনে কিছু জুয়াড়ি শেয়ার দায়ী। যেগুলো গত কয়েকদিন ধরে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে। শেয়ারগুলোর মধ্যে রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপের ওরিয়ন ইনফিউশন, ওরিয়ন ফার্মা, বিকন ফার্মা, কোহিনূর কেমিক্যাল, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন-বিএসসি, জেএমআই হসপিটাল, জেএমআই সিরিঞ্জ, বিডকম, ইস্টার্ন হাউজিং, শাইনপুকুর সিরামিক, ইউনিক হোটেল, জেনেক্স ইনফোসিস, নাহি অ্যালুমিনিয়াম, আরডি ফুড ইত্যাদি।

তারা বলছেন, কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর আগের দিনের মতো আজও দিনের মধ্যভাগে সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হতে দেখা যায়। বেলা ১টার সময় প্রায় সব শেয়ারই বিক্রেতা সংকটে হয়ে হল্টেড হয়ে যায়। কোম্পানিগুলোর শেয়ারে এই সময়ে হল্টেড প্রাইসে লাখ লাখ ক্রেতার অবস্থান দেখা যায়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারে হঠাৎ শুরু হয় বিক্রির হুলস্থুল। এতে জুয়াড়ি শেয়ারগুলোর দাম টানা নামতে থাকে, পাশাপাশি নামতে থাকে সূচকও। দিনশেষে সূচক পড়ে যায় ১৪ পয়েন্টের বেশি। যদিও লেনদেন শেষে সমন্বয়ের ফলে পতন স্থির হয় ৪ পয়েন্টে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চিহ্নিত কিছু কোম্পানি এখন পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কোম্পানিগুলোর দর বাড়লে বাজারের সূচক বাড়ছে, আবার কোম্পানিগুলোর লেনদেন কমলে বাজারের লেনদেনও কমছে। কোম্পানিগুলোর ক্রস ট্রেডের কারণে লেনদেনে উল্লম্ফনও ঘটছে। আবার সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের কারণে দামও আকাশচুম্বী হচ্ছে। তারা বলছেন, বর্তমানে লেনদেন ও সূচকের উত্থানের প্রভাব বাজারের অন্যান্য শেয়ারগুলোতে পড়ছে না। যা বাজারের জন্য মোটেও শুভ নয়। বাজার যে স্বাভাবিকভাবে চলছে না, এটা তার স্পষ্ট প্রমাণ।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, আজ লেনদেনের শীর্ষে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকার। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ওরিয়ন ফার্মার ৩২৭ কোটি ২৫ লাখ ১৭ হাজার টাকার। তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শিপিং করপোরেশনের ১৫৫ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার টাকার। এই তিন কোম্পানিই লেনদেনের বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে।

লেনদেন দখলের শীর্ষে অন্য জুয়াড়ি কোম্পানিগুলো হলো- জেএমআই হসপিটাল, ইস্টার্ন হাউজিং, শাইনপুকুর সিরামিক, জেনেক্স ইনফোসিস, নাহি অ্যালুমিনিয়াম, কোহিনূর কেমিক্যাল। লেনেদেনের শীর্ষে অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে ছিল লাফার্জহোলসিম, একমি ল্যাবরেটরিজ, বেক্সিমকো ফার্মা।

আজ ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮৩২ কোটি ২৩ হাজার টাকা। যা গত ১ বছর ১৩ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন। এর আগে ২০২১ সালে ৭ নভেম্বর লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮৬৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। তার আগের দিন ৬ নভেম্বর লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৯০১ কোটি ৫২ লাখ টাকা।

সর্বোচ্চ লেনদেনের দিনেও আজ তালিকাভুক্ত ৩৮৬ কোম্পানির মধ্যে ৪২টি কোম্পানির কোনো লেনদেন হয়নি। আরও ৪৮টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে ১০০টি শেয়ারের নিচে। যেখানে তিন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে প্রায় সোয়া ৮০০ কোটি টাকা, সেখানে প্রায় শতাধিক কোম্পানির লেনদেন হয়েছে প্রতিটি দশ হাজার টাকার নিচে। আজ ডিএসইতে ৭২টি কোম্পানির দাম বেড়েছে, বিপরীতে কমেছে ১৫৬টির। ১৪৫টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে আগের দিনের দরে। এর মধ্যে সিংহভাগই ফ্লোর প্রাইসের কোম্পানি। যা স্বাভাবিক বাজারের দৃষ্টান্ত বহন করে না।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, যেখানে লভ্যাংশ ঘোষণার অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোনের মতো শক্ত মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে বা ফ্লোর প্রাইসের কাছাকাছি লেনদেন হচ্ছে, সেখানে দুর্বল মৌলের জুয়াড়ি শেয়ারগুলো দিনের পর দিন সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হচ্ছে। চোখের পলকে শেয়ারগুলোর দর দুইগুন থেকে তিনগুন দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলাদিনের প্রদীপে যেন শেয়ারগুলো আলোতে ভাসছে।