শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) দেখিয়েছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা। যা আগের বছর ছিল ১ টাকা শূন্য ২ পয়সা। মুনাফায় বড় উত্থানের খবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। মুনাফায় বড় অগ্রগতি দেখে বিনিয়োগকারীরা চড়া দরেও শেয়ারটি লুফে নেয়।

তারপর বছর শেষে কোম্পানিটির মুনাফা যেখানে বড় আকারে বাড়ার কথা, সেখানে গোটা বছরের জন্য শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখানো হয় ৯৯ পয়সা। অর্থাৎ চতুর্থ প্রান্তিকে বা শেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান দেখানো হয় ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এতে শেয়ারটির দর তলানিতে এসে ঠেকে। বিনিয়োগকারীদের কপালে বড় ভাঁজ পড়ে।

বাজার বিশ্লেষণ: অর্থবছর শেষ হওয়ার চার মাসের মধ্যে যেখানে লভ্যাংশ ঘোষণা করার কথা অর্থাৎ এপ্রিলের মধ্যে যেখানে লভ্যাংশ ঘোষণা করার কথা, সেখানে কোম্পানিটি লভ্যাংশ ঘোষণা বিলম্ব করতে থাকে। এতে শেয়ারটির দরে নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয় এবং এর দর ধারাবাহিক কমতে থেকে। এরপর নির্ধারিত সময়ের ৪ মাস পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ঘোষণার কথা জানায়।

২০২১ অর্থবছরের জন্য কোম্পানিটি ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। যা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই কোম্পানিটির খারাপ লভ্যাংশের খবর ছড়াতে থাকে। ফলে সেপ্টেম্বর মাসজুড়েই কোম্পানিটির শেয়ার দরে ছিল ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রবণতা।

যেভাবে মুনাফায় প্রতারণা হয়: ২০২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ ’২১ প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ঘোষণা করে ৩১ পয়সা। যা আগের বছর ছিল ০৯ পয়সা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ২২ পয়সা বা ২৪৪ শতাংশ।

দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন ’২১ প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা দেখানো হয় ৪৯ পয়সা। যা আগের বছর ছিল শূন্য ২ পয়সা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ৪৭ পয়সা বা ২৩৫০ শতাংশ। এতে দুই প্রান্তিকে বা ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) মুনাফা আসে ৯০ পয়সা। যা আগের বছর ছিল ১০ পয়সা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি আসে ৮০ পয়সা বা ৮০০ শতাংশ বা ৮ গুণ।

তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির ইপিএস আসে ১ টাকা ৯৫ পয়সা। যা আগের বছর ছিল ৯১ পয়সা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ১ টাকা শূন্য ৪ পয়সা বা ১১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন প্রান্তিকে বা ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) মুনাফা আসে ২ টাকা ৭৫ পয়সা। যা আগের বছর ছিল ১ টাকা ০২ পয়সা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি আসে ১ টাকা ৭৩ পয়সা বা ১৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ।

কিন্তু বছরশেষে অর্থাৎ ২০২১ অর্থবছরে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখিয়েছে ৯৯ পয়সা। এতে দেখা যায়, চতুর্থ প্রান্তিকে বা শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩ টাকা ৭৪ পয়সা। যে কারণে বছরশেষে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৯৯ পয়সা।

যেভাবে শেয়ার দরে উত্থান-পতন চলে: ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১৮ টাকা ৪০ পয়সা। যা ২৫ মে বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ টাকায়। এরপর দর কিছুটা সংশোধন হয়ে ২৭ জুন ২৫ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে আসে।

সেখার থেকে আবার উত্থান শুরু হয়। যা একটানা বেড়ে ২৫ সেপ্টেম্বর এসে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা ৭০ পয়সায়। সেখান থেকে আবারও দর সংশোধন হতে থাকে। যা ২৫ আগস্ট ২৬ টাকা ৭০ পয়সায় এসে স্থির হয়। সেখান থেকে ফের উত্থান। চলতি ২০২২ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি এসে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা ৪০ পয়সা।

এরপর যখন কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণায় বিলম্ব করতে থাকে, কোম্পানিটির শেয়ারদরও পড়তে থাকে। এরপর কোম্পানিটির মুনাফার ধসের খবর বাজারে ছড়াতে থাকে। তখন শেয়ারটির দরে পতন প্রবণতা আরও ঘনীভূত হতে থাকে। লভ্যাংশ ঘোষণার আগের দিন কোম্পানিটির শেয়ারদর এসে দাঁড়ায় ২৫ টাকা ৩০ পয়সায়। আর লভ্যাংশ ঘোষণার দিন পতন আরও ভারী হয়। সেদিন ডিএসইতে কোম্পানিটি পতনের শীর্ষ তালিকায় প্রথম কোম্পানি হিসেবে উঠে আসে। এদিন পতন হয় ১ টাকা ৪০ পয়সা বা ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।

কেন শেষ প্রান্তিকে লোকসান: ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক থেকে তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত কোম্পানিটি ধারাবাহিক মুনাফায় ছিল। চতুর্থ প্রান্তিকে বা শেষ প্রান্তিকে মুনাফা যেখানে আরও বাড়ার কথা, সেখানে কোম্পানিটি বড় লোকসানে নামে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে তাদের ৫৭ কোটি টাকার প্রভিশন রাখতে হয়েছে। যে কারণে শেষ প্রান্তিকে মুনাফাতো হয়ইনি, বরং বড় লোকসান গুনতে হয়েছে।

বড় মুনাফায় থাকা কোম্পানিটি কেন লোকসানের কবলে পড়েছে, এর কারণ জানতে চাইলে বে লিজিংয়ের কোম্পানি সচিব শারমিন আক্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিশন রুল পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের বড় কয়েকজন গ্রাহক সময়মতো টাকা দেননি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে আমাদের প্রভিশন করতে হয়েছে।’

প্রভিশন রাখার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত: এ বিষয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘নিয়ম হচ্ছে প্রতি কোয়ার্টারে প্রভিশন রাখতে হয়, একবারে বছর শেষে প্রভিশন রাখা এটা সঠিক নিয়ম নয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেখে নিয়ম পরিপালন হচ্ছে না, সে তো চাপ দিবেই, প্রভিশন রাখা দরকার ছিল কিন্তু প্রভিশন রাখা হয়নি, বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা করিয়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটা রেয়ার কেস।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম বিষয়টিতে বলেন, ‘এটা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা আর অব্যবস্থাপনা। প্রভিশন প্রতি কোয়ার্টারে রাখতে হয় সেটা না রেখে ৯ মাসে ভালো মুনাফা দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়েছে। তাদের বড় ক্ষতির মধ্যে ফেলা হয়েছে।’

ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কথা: আবু রায়হান নামে বে লিজিংয়ের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর মাসে যখন নয় মাসের মুনাফ ঘোষণা করেছিল বে-লিজিং, তার আগে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ২৭ টাকা। এরপর কয়েক দফায় বেড়ে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩৬ টাকা ৪০ পয়াসায় ওঠে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে ৩৫ টাকা ২০ পয়সায় প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ শেয়ারের লেনদেন হয়।

পরের দিন ৯ তারিখে ৩৬ টাকা ৪০ পয়সায় ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়। এর পরেই এই শেয়ারের দামে ধস নামে। বর্তমানে শেয়ারটি ২৪ টাকার ঘরে লেনদেন হচ্ছে, যা আগের তুলনায় ১২ টাকা বা ৫২ শতাংশ কম। সে সময় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারী এই শেয়ার বেশি দামে কিনেন পরে দাম বাড়ার আশায় ও ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আশায়। কিন্তু তাদের সবাইকে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতামত: বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বে লিজিং ২০২১ সালে বিনিয়োগকরীদের জন্য ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ বোনাস লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের দিতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন দিলেই বিনিয়োগকারীদের মাঝে এ লভ্যাংশ বিতরণ করা যাবে। এখানেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের টেনশন এখানেই শেষ নয়।

উল্লেখ্য, আগামী ৩০ অক্টোবর কোম্পানিটির সাধারণ সভা (এজিএম) নির্ধারণ করা হয়েছে। এর জন্য রেকর্ড ডেট ঠিক হয়েছে ৬ অক্টোবর। এজিএমে ঘোষিত বোনাস লভ্যাংশ অনুমোদন পেলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হবে।

কোম্পানির আনুষঙ্গিক তথ্য: বে লিজিং শেয়ারবাজারে ২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন তিনশ’ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৪০ কোটি ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ৪৩০ টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ১২৬ কোটি ০৩ লাখ টাকা।

কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ১৪ কোটি ৮ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৩টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৩০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দশমিক ১৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ শেয়ার।