শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে রীতিমতো তারকা খ্যাতি আবুল খায়ের হিরুকে শেয়ার কারসাজির দায়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিএসইসি ২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে এ দুই কোটি টাকা জরিমানা নিয়ে ফেসবুকে চলছে হাস্যরস্য। কারণ পুঁজিবাজারে এখন আবুল খায়ের হিরুর ভূমিকাকে তুলনা দেয়া হচ্ছে আরব্য রজনীর আলাদিনের সঙ্গে। বাজারে তার এতটাই প্রভাব, তিনি যে শেয়ারে হাত দিচ্ছেন, মুহূর্তের মধ্যে সেটির দাম বেড়ে যাচ্ছে।

বিনিয়োগকারীদের কাছে তিনি রাতারাতি একজন বড় তারকা হয়ে উঠেছেন। তিনি কোন কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, সেটি জানার জন্যও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহের কমতি নেই। আবুল খায়ের হিরুই একমাত্র প্রথম শ্রেণির আমলা, যিনি কোনো ধরনের রাখঢাক না করে সরাসরি বাজারে জুয়া খেলায় মেতেছেন। বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ থাকলেও তিনি কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। শর্ত ভেঙে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের নামে ফটকাবাজি করছেন। জুয়ার আসর বসিয়ে সর্দার সেজেছেন পুঁজিবাজারে।

তার কয়েকশ কোটি টাকার ফটকাবাজি কারবারে এখন পথে বসেছেন লাখো বিনিয়োগকারী। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, সিরিয়াল ট্রেডিং বা দর নিয়ন্ত্রণের জন্য শেয়ারের লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তাই ফটকা বিনিয়োগ, অস্বাভাবিক ওঠানামা করা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে বা এ ধরনের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য জড়িত হতে পারবেন না।

এমনকি তার পরিবারের কোনো সদস্য পর্যন্ত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এ দুটিকে তুচ্ছ করেই পুঁজিবাজারে শুধু বিনিয়োগই নয়, বলা যায় দেশের পুঁজিবাজারকে জুয়ার আসর বানিয়ে ফেলেছেন আবুল খায়ের হিরু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিরুর কারণে অনেকেই বড় অঙ্কের অর্থ বানিয়েছে। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। গত এক বছরে শত শত বিনিয়োগকারী পথের ফকির হয়েছেন। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, এনআরবিসি, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল হাউজিং, জেনেক্স ইনফোসিস, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স, এশিয়া ইন্সুরেন্স, ফরচুন সুজ। এসব কোম্পানিতে যারা বিনিয়োগ করছেন তারা আজ পথের ফকির।

মুলত এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স এবং গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দামে হেরফের করার জন্য বিএসইসি সাম্প্রতিক সভায় হিরুকে জরিমানা করেছে বলে বিএসইসি’র একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি হিরুর বিরুদ্ধে বাজার কারসাজির অভিযোগ উঠলে বিএসইসি একটি তদন্ত শুরু করে যা এখন চলছে।

বিনিয়োকারী মহিউদ্দিন রাজ বলেন, ‘১৩০ টাকা শেয়ারদরের প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কিনে মাত্র ৫৫ টাকায় বিক্রি করেছি। প্রতি শেয়ারে ৭০ টাকা লোকসান দিয়ে এখন পথের ফকির হয়ে গেছি। এখন আমার মতো হাজার হাজার মহিউদ্দিন আছে ঢাকা শহরে।’

বিনিয়োগকারী কাশেম বলেন, ৮০ টাকা শেয়ারদরে ন্যাশনাল হাউজিং কিনে ৪৫ টাকায় বিক্রি করছি। প্রতি শেয়ারে ৩৫ টাকা লোকসান হয়েছে। আমি গত জানুয়ারী মাসে ৩৭ টাকা লাখ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করি। বর্তমানে আমার পোর্টফোলিও মাইনাসে।

খৃুলনার শহিদুজ্জামান ঢাকার একটি বেসরকারী কোম্পানিতে চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিরুর সাথে সর্ম্পক। গত জানুয়ারী মাসে হিরুর কথায় জেনেক্স ইনফোসিস ১৭০ টাকা করে শেয়ার কিনে ৯০ টাকায় বিক্রি করি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হওয়া স্বত্বে হিরু কথায় বিনিয়োগ করে ২৩ লাখ টাকা হারিয়েছি। এরকম অসংখ্য উদাহরন রয়েছে হিরুর বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মচারী হিরু টাকা দিয়ে সবকিছু করতে অভ্যস্ত। তার টাকার কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এ কারণে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একাধিকবার পুঁজিবাজারের রোড শোতে অংশগ্রহণ করতে বিদেশ সফর করেছেন নিয়মিত। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সমবায় ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা।

এদিকে হিরুর কারণে বেশ কয়েকটি ব্যাংকসহ অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও তলানিতে চলে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পোর্টফোলিও ম্যানেজ করা হতো হিরুর নির্দেশে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার এক শ্রেণির দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তার সঙ্গেই আঁতাত করে দীর্ঘদিন ধরে তিনি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে চলেছেন। শুধু বিনিয়োগই নন এখন তিনি বাজারের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল পরিচালনা করছেন। নিজ নামের পাশাপাশি স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বিও হিসাব পরিচালনা করেন এই হিরু।

সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ারের দর বাড়িয়েছেন ডজন খানেক কোম্পানির। শুধু তাই নয়, কৃত্রিমভাবে দর বাড়িয়ে চলেছেন নানা অখ্যাত ও ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়া কোম্পানিরও। এভাবে কয়েক শতকোটি টাকার মালিক বনে গিয়েছেন তিনি। তার প্রভাবের কারণে এখন মূল ধারার বিনিয়োগকারীরা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। কারণ হচ্ছে, হিরু যে শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন সেই শেয়ারেরই দর বাড়বে। ফলে যেকোনো শেয়ারের লেনদেনের পূর্বে বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে জেনে নেন এই শেয়ারে হিরুর কোনো বিনিয়োগ আছে কি না।

বিশেষ করে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। করোনা মহামারির শনাক্তের হার তীব্র হওয়ার সময়ে আলোচিত হয়ে উঠেন হিরু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তার। গত বছরের শেষ পর্যন্ত তার ছোয়া লাগা শেয়ারগুলোর দরই শুধু অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত জুন ২০২০ থেকে জানুয়ারী ২০২১ পর্যন্ত আট মাসে, এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ৬৫৮ শতাংশ বেড়ে ১২৯ টাকা হয়েছে। জুলাই ২০২০ থেকে অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৮৫৯ শতাংশ বেড়ে ১৬৩ টাকা হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত তিন মাসে, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ২০০ শতাংশ বেড়ে ১৪৪ টাকা হয়েছে। গত দুই বছরের মধ্যে শেয়ার সর্বোচ্চে পৌঁছানোর পর টানা দরপতন হয়েছে। ফলে ঐসব কোম্পানির শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করছেন তারা আজ পথের ফকির।

মুলত হিরু ২০২০ সালে বীমা শেয়ারের আকস্মিক উল্লম্ফনের জন্য দায়ী কেলেঙ্কারী হিসাবে শিরোনাম করেছিল। অন্যান্য বেশ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য তার দিকে আঙুল তোলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে, বিএসইসি এই মূল্য বৃদ্ধির পিছনে কোনও “ফাউল প্লে” ছিল কিনা তা দেখার জন্য তদন্ত শুরু করে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মোঃ আবুল খায়ের হিরু বলেন, “আমি শুনেছি আমাকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে এখনো নিয়ন্ত্রক সংস্থারৎ কাছ থেকে কোনো চিঠি পাইনি।” একটি প্রসঙ্গে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে বাজারে ব্যবসা করছি। বাজারে বড় বিনিয়োগ করতে গিয়ে কিছু ভুল হতে পারে। আইন লঙ্ঘন হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে।

একটি নাটকীয় উত্থান: আবুল খায়ের হিরু সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। ৩১তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি এই পদে যোগদান করেন। ২০২০ সালের আগে তিনি স্টক মার্কেটে সম্পূর্ণ অজানা ছিলেন। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে, বীমা শেয়ারের দাম, বিশেষ করে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলির শেয়ারের অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের পরে তার নাম প্রথম সামনে আসে।

হিরু মূলত সমবায় বিভাগের তহবিল স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন, যা তাকে প্রচুর উপার্জন করেছে বলে জানা গেছে। সাফল্যের পর অনেক বিনিয়োগকারী তার সাথে যোগ দেয়, তাকে বাজারে একটি নাম অর্জন করতে সহায়তা করে। বলা হয়, তিনি বর্তমানে বাজারে ২,০০০ কোটি টাকারও বেশি তহবিল বজায় রেখেছেন।

সমবায় তহবিল ছাড়াও হিরু তার স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের নামেও শেয়ার ব্যবসা করতেন। তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান মোনার্ক হোল্ডিংস নামের একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন। মোনার্ক হোল্ডিংস চেয়ারম্যান হলেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। শাকিবের সঙ্গেও হিরুর ভালো সম্পর্ক। এছাড়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ক্রিকেট দল ফরচুন বরিশালের সঙ্গে জড়িত হিরু। বিদেশে বিএসইসি আয়োজিত বিভিন্ন রোড শোতেও অংশ নিয়েছেন তিনি।