শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ফাঁস হয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও ইউনিট ক্রয়-বিক্রয়ের মতো অতি স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় তথ্য। যা দিয়ে স্বার্থ হাসিল করছে একটি মহল। এমন একটি বিষয় ফাঁস হওয়াকে শেয়ারবাজারের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এর আগে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল।

শেয়ারের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (সিএসই)। এর মধ্যে সিডিবিএলে বিনিয়োগকারীদের সব শেয়ার সংরক্ষিত থাকে। অন্যদিকে বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই তাদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে লেনদেন মনিটরিং করে থাকে।

এই চারটি প্রতিষ্ঠানের যে কোনো এক বা একাধিক জায়গা থেকে এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লেনদেনের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ডিএসই থেকে ফাঁস হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাছেও শেয়ার লেনদেনের গোপন তথ্য সিডিবিএল থেকে প্রদান করা হয়। যেটা বে আইনী নয়।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘তথ্য পাচারের অনেক ছিদ্র রয়েছে। ডিএসই, বিএসইসি, সিএসইসি ও সিডিবিএল ছাড়াও কোম্পানির কাছে তথ্য প্রদান একটি বড় ছিদ্র। আমরা আমাদের অংশে অর্থাৎ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কোনো তথ্য পাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে এমডি সাহেবকে অনুরোধ করেছি।’

এদিকে ডিএসই সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ডিএসই তদন্তে নেমেছে। সত্যি সত্যি ডিএসইর কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী শেয়ার লেনদেনের গোপন তথ্য পাচার করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, সিডিবিএল থেকে কোম্পানির কাছে একদিন পর শেয়ার লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করা হয়। কিন্তু লেনদেন সংক্রান্ত গোপন খবর লেনদেন চলাকালীনই পাচার হচ্ছে। যা ফেসবুক, ভাইভার, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজ ও বিনিয়োগকারীর কাছে। টাকার বিনিময়ে এসব তথ্য লেনদেন হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারের সবচেয়ে স্পর্শকাতর হল স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভিল্যান্স। কারণ দৈনন্দিন লেনদেনের সব তথ্য এখানে থাকে। এ জন্য সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়, যাতে বাইরে তথ্য ফাঁস না হয়। কোনো বড় ব্রোকারেজ হাউস, মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ কোন বিনিয়োগকারী কোন কোম্পানির শেয়ার কী মূল্যে কিনছে, তার সব তথ্য মুহূর্তেই এখান থেকে জানা যায়।

এসব কারণে সার্ভিল্যান্স রুমে স্টক এক্সচেঞ্জের বোর্ড সদস্যদেরও প্রবেশের অনুমতি নেই। সব সময় সিসিটিভি দিয়ে সংরক্ষিত সার্ভিল্যান্স রুমটি চিফ রেগুলেটর অফিসারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ টিম সরাসরি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে দায়বদ্ধ।

টিমে যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন, তারা লেনদেনের সময় মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু সর্ষের মধ্যেও ভূত আছে। এত সতর্কতা সত্তে¡ও সাম্প্রতিক সময়ে সার্ভিল্যান্স থেকে বিনিয়োগকারীদের তথ্য ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যদিও সাধারণ কারও পক্ষে তা অসম্ভব। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে ভেতরের কেউ না কেউ তথ্য ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।

এর আগে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তাতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ ছাপা হলে ডিএসই বোর্ডের নজরে আসে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের স্বার্থে লেনদেনের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখা উচিত। লেনদেন ও শেয়ার ধারণের তথ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আমানত। এই আমানত রক্ষা করা সংশ্লিষ্টদের পবিত্র দায়িত্ব। যেহেতু চারটির বেশি জায়গা থেকে তথ্য ফাঁসের সুযোগ নেই, তাই ওই চারটি জায়গায় নজর দিলেই তা বন্ধ করা সম্ভব।

উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে একটি স্বার্থান্বেষী মহল শেয়ার লেনদেনের তথ্য ফাঁস করা শুরু করে। যা নিয়ে ইতিমধ্যে বেসকিছু গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ থেকে শেয়ার কেনাবেচার তথ্য পাচার সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, গত অক্টোবর মাস থেকে ডিএসই থেকে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য ফাঁস হচ্ছে। সাধারণত লেনদেন শেষে কোন ব্রোকারেজ হাউজ কি পরিমাণ কিনছে এবং বিক্রয় করছে তা ফাঁস করা হয়। এমনকি লেনদেন চলাকালীন সময়ও এ তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। শেয়ার লেনদেনের গোপন তথ্য দিয়ে অন্যরা ক্রয়-বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন বলে যোগ করেন তিনি।

কোন নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ার কোন ব্রোকারেজ হাউজ থেকে কেনা হচ্ছে এবং কোন ব্রোকারেজ হাউজ থেকে বেচা হচ্ছে তা ফাঁস হচ্ছে। ডিএসইর ট্রেকহোল্ডার ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কেনা-বেচার তথ্য ডিএসই থেকে ফাঁস হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ২ অক্টোবর এপেক্স স্পিনিং ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য ফাঁস হয় ওইদিন লেনদেন শেষ হওয়ার পরে। এক্ষেত্রে ২০টি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে ১১ হাজার ৪৪৯টি শেয়ার কেনার তথ্য ফাঁস করা হয়। কোন ব্রোকারেজ হাউজ থেকে কি পরিমাণ ক্রয় করা হয়েছে তা পাওয়া যাচ্ছে ফাঁস হওয়া তথ্যে।

দেখা গেছে, এমেস সিকিউরিটিজ থেকে এপেক্স স্পিনিং ৩ হাজার ৬৭৪টি শেয়ার কেনা হয়েছে। আর ধানমন্ডি সিকিউরিটিজ থেকে ২ হাজার ৬৭৭টি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ১ হাজার টি, ডেসা সিকিউরিটিজ ৭০০টি, আলহাজ্ব সিকিউরিটিজ থেকে ৫৫০টি, বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজ থেকে ৫০০টি, সালতা সিকিউরিটিজ থেকে ৫০০টি, ফনিক্স থেকে ৪৩৫টি, মিকা সিকিউরিটিজ থেকে ৩০০টি, গেøাব সিকিউরিটিজ থেকে ২০০টি, রয়েল ক্যাপিটাল থেকে ২০০টি,

ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি থেকে ১৫০টি, এনসিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজ থেকে ১৫০টি ও রাজ্জাক সিকিউরিটিজ থেকে ১০০টি, সিহা সিকিউরিটিজ থেকে ১০০টি , র‌্যামনস সিকিউরিটিজ ৫৫টি, এমিন্যান্ট সিকিউরিটিজ থেকে ৫০টি, সালাম অ্যান্ড কোম্পানি থেকে ৫০টি, পার্কওয়ে সিকিউরিটিজ ৩৮টি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ থেকে ২০টি কেনা হয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, তদন্ত করে বিএসইসির সঠিক তথ্য বের করা উচিত। এক্ষেত্রে কারা যোগসাজশ করছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।

এদিকে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য প্রকাশ করে নির্দিষ্ট কোন শেয়ারে আগ্রহ তৈরি করা চক্রের লক্ষ্য হতে পারে বলে মনে করেন আজিজুল ইসলাম। এক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকে পড়লে তারা লাভবান হবেন। যা শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃসংবাদ হবে। এক্ষেত্রে ফাঁস হওয়া তথ্যের শেয়ারে কেনার আগ্রহ থেকে বেরিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য বিনিয়োগকারীদেরকে পরামর্শ দেন তিনি।

বিএসইসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনো কোন কিছু শুনিনি। তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য ফাঁস হচ্ছে এমন অভিযোগ শুনে আসছি। বিষয়টি খতিয়ে না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএএম মাজেদুর রহমান বলেন, ঘটনার সত্যতা যাছাই না করে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই এর বিপরীতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের স্বার্থে লেনদেনের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখা উচিত। লেনদেন ও শেয়ার ধারণের তথ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আমানত। এই আমানত রক্ষা করা সংশ্লিষ্টদের পবিত্র দায়িত্ব। যেহেতু চারটির বেশি জায়গা থেকে তথ্য ফাঁসের সুযোগ নেই, তাই ওই চারটি জায়গায় নজর দিলেই তা বন্ধ করা সম্ভব।