danim-lagoশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ইউরোপের বাজারে প্রথম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশের ডেনিমস। অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও তৃতীয় স্থান দখল করেছে ডেনিমস। এ কারণে এ খাতে উদ্যোক্তাদের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাজারে দেশের ডেনিম (জিন্স) পণ্য রফতানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।

কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ ও ক্রমাগত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে একদিকে রফতানির মাধ্যমে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আসবে, অপরদিকে দেশীয় বাজারেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ইউরো স্টেটের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য আমদানি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৭৬ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে।

২০১৪তে ৯৩৯ মিলিয়ন, ২০১৩তে ৮০৮ মিলিয়ন, ২০১২তে ৭২৫ মিলিয়ন, ২০১১তে ৫৯১ মিলিয়ন এবং ২০১০ সালে ৪৪৪ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে ইউরোপে। বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক। এরপরের স্থানে যথাক্রমে রয়েছে পাকিস্তান ও চীন। এ চার দেশের মধ্যে পাকিস্তানের রফতানি প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩১ শতাংশ।

ডেনিমস উৎপাদন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেনিম বা জিন্স পণ্য রফতানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। যমুনা, পারটেক্স ও এনভয়, শাশা , এগ্রো ডেনিমসসহ স্বনামধন্য ২৮টি প্রতিষ্ঠান ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেনিম রফতানি করে দেশের সুনাম বয়ে আনছে।

এছাড়া রফতানিকে উৎসাহিত করতে এবং বিদেশী ক্রেতাদের বাংলাদেশের ডেনিম পণ্য সম্পর্কে অবহিত করতে একাধিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মেলার আয়োজন করছে। বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

কিন্তু এতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। একটি রফতানিমুখী ডেনিম কারখানা স্থাপনে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে উদ্যোক্তারা শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছেন।

সুদ পরিশোধ করতে তাদের গলদঘর্ম অবস্থা। অন্যদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও কমছে।

এ বিষয়ে যমুনা ডেনিমের ব্যবস্থাপক (বিপণন) মনিরুজ্জামান বলেন, সম্ভাবনাময় খাত হলেও গ্যাস, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা যাচ্ছে না। একদিকে গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে ক্রমাগতভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। গ্যাস নিয়ে বিপাকে রয়েছেন উদ্যোক্তারা।

আর ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ থাকায় যেসব প্রতিষ্ঠানের অর্ডার রয়েছে তারাও কারখানা সম্প্রসারণ করতে পারছে না। এছাড়া ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি বাতিল হওয়ায় রফতানিতে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। এ সেক্টরকে বিকাশের স্বার্থে সরকারকে অবশ্যই জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক বেড়েছে। অধিকাংশ কোম্পানির দর ফেসভ্যালুর কাছাকাছি থাকায় ও দর কমে আসার প্রথম প্রান্তিকে বেশকিছু কোম্পানির ইপিএস ভালো আসায় এসব কোম্পানির শেয়ারের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে।

আজ ৪৫টি কোম্পানির মধ্যে ২৩ শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে ১৩টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৯টি। এদিকে এ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মোট ১০৮ ৪০ লাখ শেয়ারের লেনদেন হয়েছে। এছাড়া শাশা ডেনিমস টপ-২০ শেয়ারের তালিকায় প্রথম স্থানে ওঠে এসেছে।

এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর এর আগের কার্যদিবসের তুলনায় ৭.১৪ শতাংশ বেড়ে ৭২ টাকায় ওঠে এসেছে। মোট ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৯০টি শেয়ার ৩২ কোটি ২১ লাখ টাকায় ৩ হাজার ৩৯১ বার হাতবদল হয়।

এছাড়া লেনদেনের ভিত্তিতে টপ-২০ শেয়ারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে এ খাতের আরেক কোম্পানি আরগন ডেনিমস। কোম্পানিটি এ তালিকার নবম স্থানে রয়েছে।

আজ কোম্পানিটির শেয়ার দর এর আগের কার্যদিবসের তুলনায় ৬.১৯ শতাংশ বেড়ে ৩০.৯০ টাকায় ওঠে এসেছে। মোট ৪৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫৯৬টি শেয়ার ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকায় ২ হাজার ৭৮৪ বার হাতবদল হয়।

অন্যদিকে সর্বোচ্চ দরে বিক্রি হলো শাশা ডেনিমসের শেয়ার। আজ সোমবার দিনশেষে এ শেয়ার লেনদেন হয় ৭২ টাকায়। ২০১৫ সালে তালিকাভুক্তির পর এ শেয়ারের সর্বোচ্চ দর ছিল ৬৯ টাকা। বরাবরই এ শেয়ারের চাহিদা থাকার কারণে দর বেড়েছে বলে মনে করছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

কোম্পানিটি গতকালের লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, চাহিদা থাকার কারণে সকাল থেকে ঊর্ধ্বমুখী ছিল শেয়ারদর। দিনজুড়ে শেয়ারের দর ওঠানামা করা ৬৫ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৭৩ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যে। দিন শেষে মূল্য স্থির হয় ৭২ টাকায়। এক দিনের ব্যবধানে প্রতিটি শেয়ারের দর বাড়ে চার টাকা ৮০ পয়সা।

এ দিন কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয় ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৯০টি। আর এ শেয়ারগুলো বেচাকেনা হয় তিন হাজার ৩৯১ বার হাতবদলের মধ্যে দিয়ে।

শেয়ারের দর বাড়ার বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে কি না তা জানতে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (ফাইন্যান্স) আহসানুল হক সোহেল বলেন,  ‘শেয়ারদর বাড়ার বিশেষ কোনো কারণ আমার জানা নেই। তবে শুরু থেকে আমাদের শেয়ারের চাহিদা রয়েছে। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি আস্থা রয়েছে ক্রেতাদের। হয়তোবা ক্রেতাদের সে চাহিদা থেকে দর বাড়তে পারে।’

এদিকে সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে এক টাকা ১০ পয়সা। গত বছর যা ছিল এক টাকা পাঁচ পয়সা।  বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ৪৪ টাকা ৪৬ পয়সা। গত বছর যা ছিল ৪৪ টাকা ৮৬ পয়সা।

ধারাবাহিক মুনাফায় থাকা এ প্রতিষ্ঠানটি এ বছর মুনাফা করেছে ৮৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আগের বছর যা ছিল  ১৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ শেয়ারহোল্ডারদের ২৫ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেন।

২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে পরিচালকদের কাছে। এছাড়া  সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ২৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার।  বাকি শেয়ারের মধ্যে ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে এবং বিদেশিদের কাছে রয়েছে ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ শেয়ার।

তবে এতোগুলো কোম্পানির মধ্যে ডেনিম প্রস্তুতকারী এ দুই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে একাধিক বিনিয়োগকারী জানান, একসময় ওভেন পোশাকে ভালো করলেও আমরা এখন নিট পোশাকে ভালো করছি। কারণ, পশ্চাৎমুখী সংযোগ শিল্প অর্থাৎ নিটের কাপড় দেশেই হচ্ছে।

এতে করে পোশাক তৈরির লিড টাইম কমে এসেছে। ডেনিমের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনাই হয়েছে। এছাড়া বিশ্বের প্রতি তিনজন মানুষের একজন জিনস পরে। আর শীত প্রধান দেশে জিনস ছাড়া তো উপায়ই নেই।

আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ডেনিম রপ্তানিতে শীর্ষ তিন দেশের তালিকায় ওঠে এসেছে। কাজেই এটা নি:সন্দেহে বলা যায়, ডেনিম প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ ঝুঁকি অনেক কম।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে তুরস্ককে পেছনে ফেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ডেনিম পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে পৌঁছায় বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে ৯৩ কোটি ৯০ লাখ ইউরোর (১ ইউরোয় ৮৬ টাকা) ডেনিম রপ্তানি করে বাংলাদেশ। পরের বছর ২৫ শতাংশ বেড়ে ডেনিম পোশাক রপ্তানি ১১৭ কোটি ৬১ লাখ ইউরোতে দাঁড়ায়।

চলতি বছরের (জানুয়ারি থেকে জুন) ছয় মাসে ৫৬ কোটি ইউরোর ডেনিম রপ্তানি হয়েছে। এছাড়া ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে।