sakil rajibeমো. শাকিল রিজভী। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান পরিচালক। শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে সম্পৃক্ত আছেন পুঁজিবাজারের সঙ্গে। এই দীর্ঘ সময়ে দেখেছেন পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন।

ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা) পর তিনিই প্রথম পরিচালক যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। পুঁজিবাজার সম্পর্কে রয়েছে তার দেশ বিদেশের ব্যাপক অভিজ্ঞতা। তার অভিজ্ঞতার কিছু বিষয় শেয়ার করেছেন শেয়ারবার্তার পাঠকদের জন্য।

দীর্ঘদিন থেকে পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক। পুঁজিবাজারের উত্তরনের জন্য কাজ করছে দিনের পর দিন। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে পুঁজিবাজারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলাপ হয় শেয়ারবার্তার। একান্ত আলোচনায় পুঁজিবাজারের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কথোপকথনেরে চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

শেয়ারবার্তা : পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থাকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

শাকিল রিজভী: পুঁজিবাজারের বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এক কথা বলা যায়, বাজারের অবস্থা অনেকটাই অনুকূল। পাশাপাশি বাজার স্বাভাবিক গতিতে চলতে শুরু করছে। এ গতি বিরাজমান থাকলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আরো আস্থা বাড়বে।এছাড়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর যৌক্তিক দামের নিচে নেমে গেছে। আবার অনেক শেয়ারের দর যৌক্তিক পর্যায়ে আছে। এমনকি কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর নেট অ্যাসেট ভ্যালুর নিচে আছে।

বর্তমানে দেশে অর্থনীতির সব সূচক ভালো। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে বর্তমান বাজারের প্রতি আস্থার সংকটে ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। গত কয়েকদিনে পুঁজিবাজারও কিছুটা গতি ফিরে পেয়েছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে আগামী দিনে বাজার ভালো হবে।

শেয়ারবার্তা: বর্তমান বাজারের পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন ?

শাকিল রিজভী: আমি বহুবার বলেছি, আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই গুজবে কিংবা অন্যের কথার উপর নির্ভর করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। যার ফল শুভর চেয়ে অশুভই বেশি হয়। এর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আর একটি সমস্যা রয়েছে। তারা দ্রুত মুনাফা নিশ্চিত চান। ব্যবসা করতে চান তিন দিন বা চার দিনের মধ্যে। এই মানসিকতা ঠিক নয়। শেয়ার বাজার ধৈর্য্যের জায়গা। এখানে কোনোভাবেই ধৈর্য্য হারালে চলবে না। কেউ ধৈর্য্য ধারণ করলে তিনি অবশ্যই ফল পাবেন।

শেয়ারবার্তা : পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অবস্থা কেমন দেখছেন।

শাকিল রিজভী: পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করছি। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হয়ে লেনদেন বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের ইতিমধ্যে বাজারের প্রতি আস্থা ফিরেছে যে কারনে তারা গত কয়েকমাস ধরে শেয়ার পুঁজিবাজারে বেশ সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হয়েছেন। ফলে নড়েচড়ে বসেছেন প্রতিষ্ঠানিকরা। খবর বেরুচ্ছে, তারা কোনো কোনো কোম্পানির পাবলিকের হাতে থাকা সব শেয়ারও নাকি কিনে নিচ্ছে।

তাদের পাশাপাশি সাধারন বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আমারা গতিশীলতা দেখছি। হতাশা কাটিয়ে তারাও এখন লেনদেনে অংশ নিচ্ছেন।এই পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে আরো ভালোহবে। সোজা কথায় বলা যায় বাজার এখন একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এসে দাড়িয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজার এখনো ক্রয়ানুকূল। কিন্তু সূচক সাড়ে ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেলে তখন আর বাজারকে ক্রয়ানুকূল বলা যাবেনা।

শেয়ারবার্তা: পুঁজিবাজারে কিছু দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। এইসব কোম্পানির আধিপত্য ঠেকাতে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন ?

শাকিল রিজভী: আমার মনে হয় কোনটা দুর্বল আর কোনটি সবল কোম্পানি তা বিনিয়োগকারীরা বিচার করতে পারেন। তারা যদি মনে করেন এইসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ, তাহলে তারা এখানে বিনিয়োগ করবেন কেন ? বিনিয়োগকারীরাই এসব কোম্পানির আধিপত্য রুখে দিতে পারেন। যেহেতু পুঁজি তাদের তাই তাদেরই ঠিক করা উচিত এটা নিরাপদে রাখবে না ঝুঁকিতে ঠেলে দেবেন।

শেয়ারবার্তা: ব্যাংকে বিপুল পরিমান অলস টাকা পড়ে আছে। তা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে না কেনো? তবে কী আস্থার সংকট প্রবল?

শাকিল রিজভী: পুঁজিবাজারে নানা কারনে লেনদেন বাড়ছে না। তবে এর মধ্যে অবশ্যই আস্থার সংকট আছে। নানা কারণে এই আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে নীতি সমর্থন লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী যারা আছে, তাদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি এক্সপোজার প্রয়োজন।

বাজারটা এখন যে পর্যায়ে আসছে, তাদের এক্সপোজার  বাড়ানোর মোক্ষম সময় কিন্তু এটা। ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলো নানা কারণে এক্সপোজারকে ঝুঁকি হিসাবে দেখছে। এই জায়গাগুলোতে সংস্কার প্রয়োজন। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণকে যদি ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসাবে দেখে তাহলেতো সমস্যা হয় না। অবশ্য ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে বেশ অগ্রগতিও হয়েছে।

শেয়ারবার্তা: পুঁজিবাজারের অতিরিক্ত বিনিয়োগ আইনি সীমায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ বিষয় আপনার মন্তব্য।

শাকিল রিজভী : ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট নিয়ে বিনিয়োগকারীরা এক ধরনের হতাশার মধ্যে ছিলো। ইতোমধ্যে সেই হতাশার মীমাংসা হয়ে গেছে। এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হতে শুরু করলে বাজার লেনদেনে আরো গতি ফিরবে। বাজারে নতুন নতুন পণ্য চালুর বিষয়েও কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় নিলে শীঘ্রই বাজার আরো ভালো হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারন এমনিতেই প্রতিষ্ঠানিকদের সক্রিয়তায় পরিস্থিতি ক্রমেই ভালো হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসের তুলনায় পরিস্থিতির অনেক উন্নতিও হয়েছে।

যারা নিয়মিতি লেনদেন করেন তারা লাভের মুখ দেখছেন। যাদের আগের শেয়ার কেনা আছে তারাও অনেকটা এডজাস্ট করে ফেলেছেন। এখন ধৈর্য ধরে সময়মত সেল-বাই করতে পারলেই সবার ভেতর থেকে হতাশা কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ।

তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে পুঁজিবাজারের অধিকাংশ কোম্পানির শেয়াদর নিম্ম পর্যায়ে আছে। তবে সেই তুলনায় সাধারন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কোম্পানিগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা করলে নিশ্চিত লাভ করা সম্ভব। অথচ সাধারন বিনিয়োগকারীরা এই যাচাই বাছাইয়ের ধার ধারেন না। তারা করেন ঠিক উল্টোটা। তারা আজ বিনিয়োগ করে কালই লাভ করতে চান। শুধু তাই নয় তারা ১০০ টাকা বিনিয়েগে ১০০ টাকাই মুনাফা চান।

বাজারে যখন শেয়ারের দাম কমে যায় তখন তারা তাদের কাছে থাকা শেয়ারকে বোঝা মনে করে বিক্রি করে দেন আবার যখন দর বাড়ে তখন লাভের আশায় কেনা শুরু করেন। ফলে তারা অনবরতই লোকসানের মধ্যে থাকেন।

শেয়ারবার্তা: পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কোন সুত্রে বিনিয়োগ করা উচিত।

শাকিল রিজভী: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে চাইলে শেয়ারের দর যখন নিম্ম পর্যায়ে থাকে তখন বিনিয়োগ করা উচিৎ। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার প্রোফাইল ও ভিত্তি যাচাই করে নিতে হবে। অধিক মুনাফার আশায় কোনো অবস্থাতেই গুজবের উপর ভিত্তি করে বা হুজুগে বিনিয়োগ করা যাবে না। তাহলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।

শেয়ারবার্তা: প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তুলনায় সাধারন বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তা কেমন ।

শাকিল রিজভী: বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি বিনিয়োগবান্ধব হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তুলনায় সাধারন বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তা কম এ কথা ঠিক। বর্তমানে বাজারে লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের যেমন সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে সেই তুলনায় সাধারন বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তা তেমন দেখা যাচ্ছে না। তবে বাজার পরিস্থিতি আরো ভালো হলে সাধারন বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহনও বাড়বে।

নতুন যারা বিনিয়োগ করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে শাকিল রিজভী বলেন, বর্তমানে বাজার যথেষ্ট বিনিয়োগ বান্ধব। অধিকাংশ শেয়ারের দরই এখনো বিনিয়োগ অনুকূললে রয়েছে। কোম্পানিগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে দীর্ঘ বা স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা করে বিনিয়োগ করলে অধিক মুনাফা করা সম্ভব।