শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচকের দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। ফলে টানা দরপতনের বৃত্তে আটকে গেছে পুঁজিবাজার। প্রতিদিনই লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে মূল্য সূচক। এতে সূচকের ৬ হাজার পয়েন্টের যে মনস্তাত্ত্বিক সাপোর্ট ছিল সেটিও ভেঙে গেছে।

ফলে দিন যতই যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ততো ভারী হচ্ছে। আতঙ্কে অনেকে লোকসানে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করছেন। ফলে দরপতন আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। পুঁজিবাজারে এমন টানা দরপতন হওয়াকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। কারণ ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের ধাক্কা সামলিয়ে পুঁজিবাজার যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, তখনই জেড ক্যাটাগরির শেয়ার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুই সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে দুর্যোগ নেমে আসে। এরপর যুক্ত হয় বিএসইসি ও ডিএসই’র কর্তাব্যক্তিদের পারস্পরিক বিরোধ। চলতি সপ্তাহে যুক্ত হয়েছে পেনিক সেল ও ফোর্স সেল। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজার এখন বিপর্যস্ত।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার যখন আপট্রেন্ডে থাকে, তখন তথাকথিত মার্কেট মেকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মব্যক্তিদের নানা হাকডাক শোনা যায়। কিন্তু বাজারে যখন সংকট ঘনীভূত হয়, তখন যেন সবাই অদৃশ্য হয়ে যায়। বাজারের দুর্যোগ মূহুর্তে তখন আর কাউকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এটা খুবই দুঃখজনক।

তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে এখন এভাবে দুর্যোগ নামার কোনো কারণ নেই। কারণ দেশে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান। অর্থনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিতেও সুখবর আসছে। তাহলে পুঁজিবাজারে এমন দুর্যোগ অবস্থা দেখা যাবে কেন?

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা কাজী হোসাইন আলী বলেন, জেড গ্রুপ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা এই দরপতনের অন্যতম প্রধান কারণ। পুঁজিবাজার যখন ইতিবাচক ধারায় ফিরছিল ঠিক সেই সময় বিএসইসির নির্দেশে কিছু কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের পেনিক সৃষ্টি করে। এরপরও আরও কিছু কোম্পানি জেড গ্রুপে যাবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে গুজব ছড়ায় বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। সবকিছু মিলে পুঁজিবাজার দরপতনের মধ্যে পড়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৮ জানুয়ারি ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দিন প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৬ হাজার ৩৩৬ পয়েন্ট। ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর ধারাবাহিক পতনে ৬ কর্মদিবসের মাথায় ২৮ জানুয়ারি ডিএসইর সূচক নেমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৯ পয়েন্টে। পরের দিন ২৯ জানুয়ারি থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। ১০ কর্মদিবসের মাথায় ১১ ফেব্রয়ারি ডিএসইর সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে।

তারপর জেড ক্যাটাগরির শেয়ার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত বাজারে আবারও নেতিবাচক চাপ দেখা যায়। এর পর শুরু হয় টানা দরপতন। এরপর পতন আরও গভীর হয় যখন শীর্ষ মূলধনী কোম্পানি গ্রামীণফোন ও বৃটিশ অ্যামেরিকান ট্যোবাকোর ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হয়। যার ফলে বাজারে থেমে থেমে পতনের বড় ঝাপটা দেখা যায়। যা চলতি সপ্তাহের আরও তীব্র হয়েছে।

চলতি সপ্তাহে যুক্ত হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও ডিএসর মধ্যে মতবিরোধ। সাথে যোগ হয়েছে পেনিক সেল ও ফোর্স সেল আতঙ্ক। যার ফলে সপ্তাহের চার কর্মদিবসে সূচক ১০১ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

একাধিক বিনিয়োগকারী ও ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুঁজিবাজারের টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও-তে থাকা শেয়ারের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে যারা মার্জিন নিয়ে শেয়ার কিনেছিলেন, তারা এখন ফোর্স সেলে পড়েছেন। অন্যদিকে, বাজারে ধারাবাহিক পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যে কারণে তাদের মধ্যে লোকসানে থাকার পর শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএসই’র প্রধান সূচক ‘ডিএসইএক্স’ ৩২ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে। যা ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ০৭ জুন, ২০২১ তারিখে সূচক ছিলো ৫ হাজার ৯৭৫ পয়েন্ট। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচক ৯.০৮ পয়েন্ট ০.৬৯ শতাংশ কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৩০০.৮২ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৭.২৬ পয়েন্ট ০.৩৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৬.৫৬ পয়েন্টে।

আজ ডিএসইতে আগের কার্যদিবসের ব্যবধানে ৮০ কোটি ২২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা কম লেনদেন হয়েছে। মঙ্গলবার ডিএসইতে ৫৬৩ কোটি ৫৩ লাখ ২৩ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে ডিএসইতে ৩৯৮টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৪৫টির, কমেছে ৩০৮টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৫টির।

অপর পুঁজিবাজার সিএসইর প্রধান সূচক সিএসসিএক্স ৯৪.৬৮ পয়েন্ট বা ০.৯১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৭১.১৩ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৫৭.৮২ পয়েন্ট বা ০.৯১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ১০৫.৪৫ পয়েন্টে, শরিয়াহ সূচক ১০.৪৮ পয়েন্ট বা ০.৯৩ শতাংশ কমে ১ হাজার ১০৬.৩৮ পয়েন্টে এবং সিএসই৩০ সূচক ৭৭.০৩ পয়েন্ট বা ০.৫৯ শতাংশ কমে ১২ হাজার ৮৪৮.৭১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

আজ সিএসইতে ২১৭টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৬০টির, কমেছে ১৩১টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২৬টির। দিন শেষে সিএসইতে ১১ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৬ কোটি ৮৩ লাখ ১৬ হাজার টাকার শেয়ার।