শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি আজিজ পাইপস লিমিটেডের উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে পাওনা টাকা আদায়ে মামলা করেছে দুটি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংক দুটির বকেয়া ১০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে উত্তরা ব্যাংক পাবে ৭২ কোটি টাকা। বাকি ৩৪ কোটি টাকা পাবে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এদিকে ব্যবসায় না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা ব্যয় বাড়ছে। তবে কোন খাতে এসব ব্যয় হচ্ছে, তার কোনো সুস্পস্ট হিসাব নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে। বিভিন্ন খাতে কোম্পানিটি ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ব্যয় দেখালেও কোনো প্রমাণ নেই তাদের কাছে।

আজিজ পাইপস লিমিটেডের ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিরীক্ষকের মতামতে এসব বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করেছে, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের কাছে কোম্পানিটির ঋণ রয়েছে ৭২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একই সঙ্গে ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের কাছে ঋণ রয়েছে ৩৪ কোটি ২ লাখ টাকা। এ ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক দুটি ইতোমধ্যে আদালতে মামলা করেছে।

আজিজ পাইপসের কর্মকর্তারা বলছেন, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য মূলধনের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকঋণ সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে তাদের প্রতিষ্ঠানটি ঋণ আদালতে মামলার সম্মুখীন হয়েছে। এই মামলাগুলো বর্তমানে চলছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা আশা করছেন, এসব মামলায় তারা শিগগিরই জিতে আসবেন।

এদিকে অডিট প্রতিষ্ঠান তাদের মতামতে বলেছে, কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার অনাদায়ী পাওনা দেখানো হয়েছে। কিন্তু কার কাছে কত টাকা পাওনা, এ ব্যাপারে সুনির্দিস্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালে কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনে ২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার সম্পত্তি, প্ল্যান্ট ও সরঞ্জাম দেখানো হয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষকের কাছে কোনো প্রমাণ প্রদর্শন করতে পারেনি।

২০২০ সালের পর পাইপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল এবং মূলধনসংকটের কারণে দুবার উৎপাদন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছিল। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ হেমায়েত উদ্দিন নামে একজন ব্যাংকারকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর হেমায়েত উদ্দিন কোম্পানির আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ব্যাংকঋণ নিয়মিত বা পুনর্নির্ধারণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

প্রসঙ্গত, আশির দশকের শেষ দিকে দেশের অবকাঠামো খাতে বড় বড় বিনিয়োগ আসতে শুরু করলে সারা দেশে সুপেয় পানির জন্য নলকূপ স্থাপনের কাজ বড় পরিসরে শুরু হয়। আর এই কাজগুলোর জন্য প্রয়োজন পড়ে প্লাস্টিকের পাইপ। এই ব্যবসা ধরার জন্যই আজিজ পাইপস ১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৫ সালে বার্ষিক ১ হাজার ২০০ টন উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ১২ বছরে কোম্পানিটির উৎপাদনক্ষমতা বছরে ৭৫ হাজার টনে উন্নীত করেছে।

মতিঝিলের আজিজ ভবনে কোম্পানিটির হেড অফিস এবং ফরিদপুরে কারখানা। আবদুল হালিম, আহসান উল্লাহ ও আসাদ উল্লাহর হাত ধরেই কোম্পানিটি যাত্রা শুরু করে। উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে তারা এখনো কোম্পানিটির বোর্ডে রয়েছেন।

একসময় আজিজ পাইপসের বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকায়। কোম্পানিটি ১৯৮৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। পণ্য রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে জাতীয় পদক পায়। নব্বইয়ের দশকে কোম্পানিটি ঢাকার বাজারের শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় ছিল। বর্তমানে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং আইসিবি ইউনিট ফান্ডের এই কোম্পানিতে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

এদিকে কোম্পানির অডিটর রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কো. বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, ঋণ সেবা ও সুদের সেবার অনুপাত কম হওয়ায় আজিজ পাইপসের ইক্যুইটি বরাবরই কমেছে। মূলধন এবং কাঁচামালসংকটের কারণে কোম্পানিটি ২০২০-২১ আর্থিক বছরে তার উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ১১ দশমিক ২১ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে। এদিকে পাইপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর কোম্পানিটি ১৯৯৮ সালে ব্যবসা বহুমুখীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটি কাঠের বিকল্প হিসেবে প্লাইউডের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত লভ্যাংশ দিয়েছিল। এরপর লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন লভ্যাংশ দিতে পারেনি। তবে ২০১৭ সাল থেকে আবার লভ্যাংশ দিতে শুরু করে। কিন্তু লোকসানের কারণে ২০২০-২১ হিসাব বছরে লভ্যাংশ দিতে না পারলেও কোম্পানিটির শেয়ার দর নিয়মিত কারসাজি করে বাড়ানো হয়।

২০২১ সালে কোম্পানিটির শেয়ার দর কোনো কারণ ছাড়াই ৮৭ টাকা থেকে ৯০ শতাংশ বেড়ে ১৬৫ টাকায় উঠেছিল। আবার সেখান থেকে ৫০ শতাংশ কমে ৮৩ টাকায় নেমে আসে। একইভাবে কোম্পানিটির শেয়ার গত সেপ্টেম্বর মাসে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল।

এর আগে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার লেনদেন এবং দর বৃদ্ধির কারণে ২০১৮ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিজি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ( বিএসইসি) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে কোম্পানিটির লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে বিএসইসি আজিজ পাইপসের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়নি।