শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবের বিভিন্ন বিষয়ে অসঙ্গতি ও গোঁজামিল পেয়েছেন নিরীক্ষক। কোম্পানির দেখানো আয়, ব্যয়, মজুত পণ্য, সম্পদ, গ্রাহকের কাছে পাওনা, স্থায়ী সম্পদ, কর প্রদান, অবণ্টিত লভ্যাংশ, ব্যাংক হিসাবসহ আরও অনেক বিষয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কোম্পানির সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রায় ১৯৬ কোটি ৫ লাখ টাকার হিসাবে গরমিল পেয়েছে নিরীক্ষক।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কমপ্লায়েন্স ও গভর্ন্যান্স। কোম্পানিগুলো যেন সবক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্ট হয়, সে জন্য গভর্ন্যান্সের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনেক বেশি কঠোর হতে হবে।

নিরীক্ষক জানিয়েছে, নথির অপর্যাপ্ততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রভিশনিংও করেনি সেন্ট্রাল ফার্মা। প্রভিশন গঠন করলে কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ বা মুনাফা কমে যেত, বিপরীতে বাড়ত দায়। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির সম্পদ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। সেন্ট্রাল ফার্মার কাছে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা কর দাবি করে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

এর বিপরীতে কোম্পানির কেবল ২৮ কোটি ২ লাখ টাকার প্রভিশনিং করা আছে। বাকি ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার বিপরীতে কোনো প্রভিশনিং বা এনবিআরের সঙ্গে বিষয়টি সমাধান করেনি। অন্যদিকে সেন্ট্রাল ফার্মার কাছে বিভিন্ন অর্থবছরের জন্য ২৩ কোটি ১ লাখ টাকার ভ্যাট ও শাস্তি দাবি করেছে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোম্পানি ওই অর্থ প্রদান বা সমাধান করেনি। প্রভিশনিংও করেনি।

কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ঋণ দেখানো হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা ব্যাংক সার্টিফিকেট দিতে পারেনি। ব্যাংকে চিঠি দিয়েও ওই ঋণের বিষয়ে সাড়া পাননি নিরীক্ষক।

গ্রাহকদের কাছে ৮ কোটি ৪ লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে আর্থিক হিসাবে উল্লেখ করেছে সেন্ট্রাল ফার্মা। এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত প্রমাণাদি দিতে পারেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে হিসাবে দেখিয়ে আসা এই টাকা আদায় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে অগ্রিম প্রদান হিসেবে ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা অগ্রিম কর প্রদান। বাকি ২৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বিষয়ে কোনো প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি নিরীক্ষককে।

সেন্ট্রাল ফার্মার ৬৮ লাখ টাকার মজুত পণ্য, ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি, ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার কাঁচামাল ক্রয় এবং ৩৯ লাখ টাকার প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল ক্রয়ের সত্যতা পাননি নিরীক্ষক। এমনকি ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ওষুধ বিক্রির বিপরীতে ২ কোটি ৮ লাখ টাকার কাঁচামাল ব্যবহার, ১৭ লাখ টাকার সরাসরি ব্যয়, ২ কোটি ৯২ লাখ টাকার ম্যানুফ্যাকচারিং ওভারহেড কস্ট (পণ্য উৎপাদনের সব নিরপেক্ষ খরচের সমষ্টি), ৮২ লাখ টাকার প্রশাসনিক ব্যয়, স্পেয়ার পার্টস অ্যান্ড সাপ্লাইস হিসেবে দেখানো ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং ১ কোটি ৮ লাখ টাকার বিক্রি ও বিতরণ ব্যয়ের বিপরীতে প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

জনতা ব্যাংকের ঢাকা লোকাল অফিসে সেন্ট্রাল ফার্মার ৩টি হিসাব রয়েছে, যেগুলো ট্যাক্সের জন্য ২০১৫ সাল থেকে ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে। এখনো বিষয়টির সমাধান হয়নি। ফলে ইসলামী ব্যাংকে কোম্পানিটি একটি হিসাব পরিচালনা করে। ওই হিসাবে ছাড়াও অধিকাংশ লেনদেন নগদে করে কোম্পানি। এতে ব্যয় কম বা বেশি দেখানো যায়। আয়ও বাড়িয়ে বা কমিয়েও দেখানো যায় বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।

২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানিটিতে এখনো আইপিও আবেদনকারীদের ৬০ লাখ টাকা পড়ে রয়েছে। আইপিওতে আবেদন করে শেয়ার না পাওয়া সত্ত্বেও ওই টাকা কোম্পানিতে রয়ে গেছে। কোম্পানিটিতে ৯ লাখ টাকার অবণ্টিত লভ্যাংশ রয়েছে। কিন্তু এ অর্থ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা মেনে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে (সিএমএসএফ) স্থানান্তর করেনি।

সেন্ট্রাল ফার্মার আর্থিক হিসাবে ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ দেখানো হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কারখানা ও অধিকাংশ মেশিনারিজ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপরেও তারা ইমপেয়ারমেন্ট করে প্রকৃত অবস্থা বা বাজারদর নির্ণয় করেনি।

এ বিষয়ে সেন্ট্রাল ফার্মার কোম্পানি সচিব মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এসব বিষয়ে তো কিছু অভিযোগ আছেই। পণ্য বিক্রি ও ভ্যাটের বিষয়ে আমরা নথি দিয়েছি। অগ্রিম আয়কর প্রদানের বিষয়ে দিতে পারিনি। আমরা ৯৮ কোটি টাকা আয়কর পরিশোধ করিনি, সেটা এনবিআরের সঙ্গে আন্ডার প্রসেসে আছে।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, অর্থবছর শেষে নিরীক্ষকের মতামতসহ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন কমিশনে আসে। কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেটা যাচাই করে। এতে কোনো অনিয়ম বা অসঙ্গতি পেলে কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সেন্ট্রাল ফার্মার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না। এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।