শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: অনুমোদনহীন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকোর (বিএটি) ২০৫৪ কোটি টাকার দাবিনামা মওকুফ করে দিয়েছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-ভ্যাট)। এত বিপুল পরিমাণ রাজস্ব মাফের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিএটির সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) মওকুফ করা হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এলটিইউ-ভ্যাটে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেমন পরিহারকৃত রাজস্বের সঙ্গে সুদ আদায় না করা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) কার্যক্রমের আওতায় গুটিকয়েক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেয়া ইত্যাদি। এসব অভিযোগ যাচাই করতে এনবিআরের এক সদস্যের নেতৃত্বে কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে বিএটির দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকা দাবিনামা মওকুফের বিষয়টি নজরে আসে এনবিআর চেয়ারম্যানের। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করেছেন। ইতোমধ্যেই এলটিইউ-ভ্যাট থেকে একটি পরিস্থিতিপত্রের মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়টি এনবিআরকে অবহিত করেছে।

এলটিইউ-ভ্যাটের পরিস্থিতিপত্রে বলা হয়েছে, এনবিআর কর্তৃক গঠিত কমিটির প্রতিবেদন মোতাবেক দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকা আদায়ের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেজন্য এনবিআর থেকে অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়াও কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছে।

তা সত্ত্বেও কিভাবে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দাবি প্রত্যাহার করে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়, তা বোধগম্য নয়। বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচারপূর্বক বিশ্লেষণধর্মী স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে দাখিলের জন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

জানা গেছে, দাবিনামা পর্যালোচনা করতে গত ১৪ আগস্ট এনবিআরের সদস্য (মূসক নিরীক্ষা) ড. শহিদুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. আব্দুর রউফ, ঢাকা (উত্তর) ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ নেয়াজুর রহমান, ঢাকা (দক্ষিণ) ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার শওকত আলী সাদী, ঢাকা (পশ্চিম) ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার কাজী মুহম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং ঢাকা (পূর্ব) ভ্যাট কমিশনারেটের উপ-কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান। কমিটিকে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এনবিআরের আদেশে বলা হয়েছে, কমিটির সদস্যরা ভ্যাট আইনের ধারা ও বিধি যথাযথভাবে পরিপালনের মাধ্যমে রাজস্ব মওকুফ করা হয়েছে কিনা; সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গঠিত কমিটির মতামত যথাযথভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে কিনা এবং ভ্যাট আইনের ধারা ও বিধিমালার আলোকে আদেশটি জারির ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা-তা পর্যালোচনা করবে।

ঘটনার সূত্রপাত : বিএটিবি’র ২০১৬ সালের অডিট রিপোর্ট যাচাই করে ২০০ কোটি টাকা বেশি তামাক পাতা ব্যবহারের তথ্য জানতে পারে এলটিইউ-ভ্যাট। অতিরিক্ত এ তামাক পাতা দিয়ে সিগারেট বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে ২০১৮ সালে ২৯ মার্চ ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএটি অতিরিক্ত ১৯১ কোটি টাকার তামাক পাতা ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত ১৮১১ কোটি শলাকা সিগারেট বেশি উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে। এতে সরকার ২০৫৪ কোটি টাকা রাজস্ব (৪৮ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক+১৫ শতাংশ ভ্যাট) হারিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। পরে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করতে সাত সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত মত দেন।

চূড়ান্ত দাবিনামায় বলা হয়, এনবিআরের টাস্কফোর্স কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ২০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত তামাক পাতা ক্রয় করে অতিরিক্ত এক হাজার ৮০০ কোটি শলাকা সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের দাবি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটি এবং পর্যালোচনা কমিটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এ কারণে দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকার রাজস্ব পরিহারের বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত হয় না।

বার্ষিক প্রতিবেদন ও মূল্য ঘোষণা ফরমের (মূসক-১) কাঠামোগত ভিন্নতার কারণে মূল্য ঘোষণায় তামাক পাতা সংগ্রহে ওভারহেড কস্টকে তামাক পাতার সাথে যোগ না করে সমজাতীয় অন্য ওভারহেড কস্টের সঙ্গে যোগ করে প্রদর্শন করা হয়েছে। এছাড়াও বিএটি ভ্যাট আরোপযোগ্য সেবা গ্রহণের সময় উৎসে ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত অনিয়ম হলেও কর ফাঁকি সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করা যায় না। এক্ষেত্রে বিভাগীয় কর্মকর্তা অনিময় মামলা দায়ের করতে পারেন।