শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফের ৩৪ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। এ কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বিদেশি, ব্যবস্থাপনা পরিচালকও বিদেশি। এই দুই বিদেশি মিলে গত কয়েক বছরে পণ্যের বৈচিত্র্য এনে ভোক্তাদের নজর কেড়েছেন। করোনা-পূর্ববর্তী ২০১৯ সালে সিঙ্গার বাংলাদেশ রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে।

কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে প্রাপ্ত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে। দুই বিদেশি শীর্ষ নির্বাহীর পুকুর চুরি দেশি প্রতিষ্ঠানকেও হার মানিয়েছে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের বছরের পর বছর ঠকিয়ে আসছে কোম্পানিটি। কোম্পানিটি ২০১৭ সালে ১০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে লভ্যাংশ চলে আসছে ১০ শতাংশ ক্যাশ। ঐ সময় কোম্পানিটির বছর শেষে মুনাফা হয়েছে মাত্র.৭৩ পয়সা।

২০২১ সালেও কোম্পানিটি ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে ঐ সময় কোম্পানিটি মুনাফর করে ৫ টাবা ২০ পয়সা, এরপর ২০২০ সালে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে ঐ সময় কোম্পানিটি মুনাফা করে ৭ টাকা ৪৫ পয়সা। ২০১৯ সালে ৭৭ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে ঐ সময় কোম্পানিটির মুনাফা করে ১০ টাকা ৩৫ পয়সা।

২০১৮ সালে কোম্পানিটি ৩০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে ঐ সময় কোম্পানিটি মুনাফা করে ১১ টাকা ৩৬ পয়সা। এখন প্রশ্ন ২০২২ সালে কোম্পানিটির মুনাফায় এমন কী পতন হলো, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করলেও সিঙ্গার বিডি যে দেশী কোম্পানির মত মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করলো। এ ভাবে কোম্পানিটি লভ্যাংশ ঠকিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের। তাই কোম্পানিটির গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই বাছাই করার দাবী জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও বাংলাদেশের আইনকানুনকে পাত্তা না দিয়ে বছরের পর বছর বিক্রির তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন ভ্যাটের নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বড় অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকির সাতকাহন বেরিয়ে এসেছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কোম্পানিটি বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও ঠিকমতো সরকারের রাজস্ব পরিশোধ করছে না। প্রতিষ্ঠানটি গত পাঁচ বছরে ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন ভ্যাটের নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বড় অঙ্কের এই ফাঁকির চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া শুধু রাজস্ব ফাঁকি নয়, অবৈধভাবে রেয়াতি সুবিধাও নিয়েছে সিঙ্গার বাংলাদেশ। একই সাথে অবৈধভাবে রেয়াতি সুবিধায় নেওয়ার প্রমান পেয়েছে, এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে ভ্যাটের নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, গত ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয় সিঙ্গার বাংলাদেশ। কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের অধীনের এক প্রতিবেদনে সিঙ্গার বাংলাদেশ ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ১৪ কোটি ২৬ লাখ ২৮ হাজার টাকার ফাঁকি বেরিয়ে আসে। অপরদিকে ভ্যাট আইন অমান্য করে ২ লাখ ২১ হাজার ১০৮ টাকার অবৈধ রেয়াত নিয়েছে বলে অভিযোগ সিঙ্গার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

পরে আরেক নিরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উৎসে মূসক ও অবৈধ রেয়াত নেওয়ার প্রমাণ মিলে। একই সাথে আরও ২০ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকার ভ্যাট না দেওয়ার চিত্র বেরিয়ে আসে। সবশেষ ভ্যাট গোয়েন্দার সমন্বিত নিরীক্ষায় ৩৪ কোটি ৬০ লাখ ১ হাজার ৮০৩ টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাট।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ৩৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ফাঁকি রাজস্ব আদায়ে দীর্ঘদিন থেকে চিঠি চালাচালি করছে এলটিইউ ও সিঙ্গার বাংলাদেশ। সর্বশেষ কোম্পানি থেকে রাজস্ব আদায়ে কঠোর হয়েছে এলটিইউ কর্তৃপক্ষ। রাজস্ব প্রসঙ্গে কোম্পানির (সিঙ্গার বাংলাদেশ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফাইরোজকে মুঠোফোনে পাওয়া গেলেও তার ব্যস্ততার কারনে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

রাজস্ব ফাঁকির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর বিষয়টি অন্যভাবে নিয়েছে। ফলে ভ্যাট ফাঁকি অভিযোগ হিসেবে দেখছে। আমার মতে, সামান্য জটিলতায় সিঙ্গারকে এমন অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। এটা নিরসনে আলোচনা চলছে জানিয়ে আরও বলেন, এলটিইউর আগে কমিশনারের সময়ে এই জটিলতা তৈরি হয়। সেই সময় থেকে এটা নিয়ে কাজ চলছে। যা এখন সমধা হয়নি। বর্তমান কমিশনার এটা নিয়ে কাজ করছে। শিগগিরই এটা সমাধান হবে।

প্রতিষ্ঠানটির তিনটি ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, জটিলতা কমাতে ও নিয়ম অনুসারে একটি ভ্যাট নিবন্ধন করার পরামর্শ দেয় এনবিআর। সেই অনুসারে, সিঙ্গার বাংলাদেশ এলটিইউ অধীনে ভ্যাট নিবন্ধন করে। বর্তমানে এলটিউর মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি মানতে নারাজ সিঙ্গার বাংলাদেশ কোম্পানি সচিব আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, এটি ভ্যাট ফাঁকি নয়, এটা একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া। আরও বলেন, এনবিআর আমাদের কাছে টাকা পাবে। আমরাও তার কাছে টাকা পাব। এটার সমন্বয় হবে।

এদিকে ২০২২ সালে মার্চ মাসে সিঙ্গার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৯৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছিল। শো-রুম, ওয়্যারহাউজের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে রেয়াত সুবিধা নিয়ে কোম্পানিটি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে জাতীয রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) সূত্রে গনমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ঐ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গার বাংলাদেশের কাছে উল্লিখিত অভিযোগের বর্তমান অবস্থা ও প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ চেয়েছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সিঙ্গার বাংলাদেশ। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন আড়াইশ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৯৯ কোটি ৭০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। শেয়ার সংখ্যা ৯ কোটি ৯৭ লাখ ২ হাজার ৮৩৮টি। কোম্পানিটির রিজার্ভে রয়েছে ১৮৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানির উদ্যোক্তাদের কাছে রয়েছে ৫৭ শতাংশ শেয়ার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, বিদেশি ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং সাধারন বিনিয়োগকারী ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ শেয়ার ধারন করেছে। সুত্র: দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকম