শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানির ২০২২ হিসাববছরে নিট মুনাফা কমেছে। কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেছে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দর বৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগের মুনাফা ও লভ্যাংশ কমেছে। তালিকাভুক্ত ১৩টি কোম্পানির মধ্যে ৯টি ২০২২ সালের আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি কোম্পানির মুনাফায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাকি চারটি কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা কমার ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল, ভিটসহ বেশ কয়েকটি প্রসাধন পণ্যের কল্যাণে বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে রেকিট বেনকিজার। ১৯৮৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি বছর এই বহুজাতিক কোম্পানিটি যে মুনাফা করেছে তার প্রায় পুরোটা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছে। নিয়মিত ভালো ব্যবসার সঙ্গে মোট লভ্যাংশ ঘোষণা করায় কোম্পানিটি খুব সহজেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করে নেয়।

ফলে দামের দিকে থেকেও সবার ওপরে স্থান এই কোম্পানির। তবে পুঁজিবাজারে চলমান সংকটের মধ্যে এবার কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটেছে কোম্পানিটি। একদিকে এই বহুজাতিক কোম্পানিটির মুনাফা কমে গেছে, অন্যদিকে কমেছে লভ্যাংশ ঘোষণার হার। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি যে মুনাফা করেছে তার ৭০ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতো কম হারে সাম্প্রতিক সময়ে আর লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি কোম্পানিটি।

যেখানে গত কয়েক বছরে নিয়মিতই মুনাফার ৯০ শতাংশ বা তার বেশি লভ্যাংশ দিয়েছে। রেকিট বেনকিজারের মতো নগদ লভ্যাংশে লাগাম টেনেছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার। ২০২২ সালের ব্যবসায় কোম্পানিটি যে মুনাফা করেছে, তার অর্ধেকও নগদ লভ্যাংশ হিসেবে দিচ্ছে না। অথচ এক বছর আগেই মুনাফার চেয়েও বেশি হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল কোম্পানিটি।

লভ্যাংশের হার কমিয়ে দেওয়ার এ তালিকায় রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোও। ডানহিল, লাকি স্ট্রাইক, কেন্ট, পলমল, কুল, বেনসন এবং রথম্যান্স তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটি তামাকজাত পণ্য বিক্রির দিকে দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানটি এক বছর আগেও বিনিয়োগকারীদের মুনাফার প্রায় পুরোটা লভ্যাংশ হিসেবে দিয়ে দেয়। কিন্তু এবার মুনাফার ৬০ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এভাবে লভ্যাংশে হার কমিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বহুজাতিক এসব কোম্পানির দায়িত্বশীলরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বে এক ধরনের সংকট চলছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লভ্যাংশ কমিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। এতে কোম্পানির আর্থিক ভিত আরও শক্তিশালী হবে।

অন্যদিকে নিয়মিত বড় লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করে নেওয়া এই কোম্পানিগুলোই এখন যেন বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। লভ্যাংশের হার কমার পাশাপাশি কিছু বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফাতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে দিনের পর দিন ক্রেতা সংকটে ভুগছে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি বিশ্ববাজারে কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কোম্পানিগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ ও অন্যান্য ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এ ছাড়া টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও এসব প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।

ফলে গত বছর এসব কোম্পানির লোকসান হয়েছে। ইলেকট্রনিকস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার বাংলাদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ৫১ কোটি টাকা। ২০২২ সালে মুনাফা নেমে এসেছে ৭ কোটি ৩১ লাখ টাকায়।

কোম্পানিটি জানিয়েছে, গত এক বছরে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তাদের মুনাফায় প্রভাব পড়েছে।

লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম মুনাফা অর্জন করেছে ২০২২ সালে। কোম্পানিটি ২০২১ সালে ১২২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা মুনাফা করে। আর ২০২২ সালে ২৮ শতাংশ কমে সেটি দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও চীনামাটির পণ্য উৎপাদনে নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আরএকে সিরামিকস। উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও ২০২২ সালে মুনাফা সংকুচিত হয়েছে। নিট মুনাফা ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশের বেশি কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি টাকায়। আগের বছরে এটি ছিল ৯০ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সারা বছর তাদের একাধিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের ঘাটতি, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং অস্থিতিশীল মুদ্রা লেনদেনের কারণে উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সিরামিক শিল্প গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। পণ্য উৎপাদনের জন্য উচ্চ প্রবাহের গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে।

ডেটল ও লাইজল জীবাণুনাশক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেকিট বেনকিজারের (বাংলাদেশ) ২০২২ সালে মুনাফা হয়েছে ৬৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ কম। ২০২১ সালে নিট মুনাফা ছিল ৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

দেশের বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোনের ২০২২ সালে নিট মুনাফা ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কমেছে। যদিও একই সময়ে তাদের আয় ৫ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানির মুনাফা ৩ হাজার ৯ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যা আগের বছর ৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকা ছিল।

অন্যদিকে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের কর-পরবর্তী মুনাফা আগের বছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়েছে। মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।

বেড়েছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের মুনাফাও। ২০২১ সালে কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ৩৫০ কোটি ৭৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।

ম্যারিকো বাংলাদেশের মুনাফা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২১ সালে ৩১০ কোটি ৯০ লাখ টাকার বিপরীতে ২০২২ সালে মুনাফা হয়েছে ৩৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে বার্জার পেইন্টসেরও। ২০২১ সালে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছিল ২৫৪ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৭ কোটি ৬০ লাখ ৯২ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ২০২২ সালে মুনাফা বেড়েছে ২২ কোটি ৭৩ লাখ ৪ হাজার টাকা।

অন্যদিকে ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ ও বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ও রবি আজিয়াটা লিমিটেড ২০২২ সালের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।