শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের ৪২ কোম্পানির মধ্যে ৪ কোম্পানির লভ্যাংশ নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বছরের পর বছর লভ্যাংশ না নিয়ে এ চার কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করছে। বিনিয়োগকারীদের টাকায় ব্যবসা করলো লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করছে চার কোম্পানি। এর মধ্যে চারটি কোম্পানি চলতি বছরের কোনো প্রান্তিকেরই আর্থিক প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। কোম্পানিগুলো হলো: অ্যাপোলো ইস্পাত, আরএসআরএম স্টিল, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ ও ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড।

অ্যাপোলো ইস্পাত, : ১৯৯৪ সালে যাত্রা করা অ্যাপোলো ইস্পাত রানী মার্কা ঢেউটিন বাজারজাত করে আসছিল। কোম্পানিটির প্রথম সিজিএল ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। দ্বিতীয় সিজিএল ইউনিট উৎপাদনে যায় ২০০২ সালে। আর ২০০৫ সালে শুরু হয় সিআরএম ইউনিটের উৎপাদন। ২০১৩ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি।

১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সঙ্গে শেয়ারপ্রতি ১২ টাকা প্রিমিয়ামে বাজার থেকে ২২০ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলন করে। নতুন এনওএফ প্লান্ট স্থাপন ও ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছিল কোম্পানিটি। এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত অ্যাপোলো ইস্পাত। অনেক আগে বন্ধ হয়ে গেছে কোম্পানিটির উৎপাদন। দেশব্যাপী পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। ‘দিই/দিচ্ছি’ বলে দীর্ঘদিন ধরে ঘোরানো হচ্ছে পাওনাদারদের।

অ্যাপোলো ইস্পাতের এক কর্মকর্তা বলেন, অ্যাপোলো ইস্পাতের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েবের একগুঁয়েমির কারণেই কোম্পানিটি ডুবেছে। বর্তমানে নানা খাতে দেনা আছে ৮৫০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৫৬০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ ২৪৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া পার্টি ঋণ রয়েছে ৪৫ কোটি টাকা।

ডিএসইকে দেওয়া কোম্পানিটির তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জিংক পট ( যেখানে গ্যালভানাইজিং করা হয়) ভেঙে যাওয়ার কারণে কোম্পানিটির সিজিএল-২ ইউনিটের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

মৃতপ্রায় অ্যাপোলো ইস্পাত ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিএসইসিকে চিঠি দিয়ে এর আইপিও অনুমোদন না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তখনকার কমিশন আইপিও অনুমোদন দেয়। পরে ২০১৬ সালের শেষের দিকে এর অধোগতি শুরু হয়। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি সর্বশেষ বিনিয়োগকারীদের ৩ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল।

২০১৯ সালে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। সেই বছর শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ২ টাকা ৩১ পয়সা। তার পর থেকেই কোম্পানিটি আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা কিছুই জানে না।

রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস: ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস (আরএসআরএম) ২০২০ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। ওই বছর শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ১ টাকা ৫ পয়সা। পরের বছর ২০২১ সালে ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করে। সে বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখানো হয় ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এর পর থেকে কোম্পানিটি আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

এদিকে, গত বছরের ১১ এপ্রিল ডিএসইর মাধ্যমে উৎপাদন পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ। তখন খাদের কিনারে থাকা কোম্পানিটির শেয়ার দাম তরতর করে বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ফায়দা লুটতেই উৎপাদন চালু করার কথা ফলাও করে প্রচার করেছিল।

যদিও উৎপাদন চালু করার বিষয়ে পরে আর কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। উৎপাদন চালু করার সিদ্ধান্ত জানানোর পর কোম্পানিটির আর কোনো তথ্য না পাওয়ায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চলতি বছরের মার্চ মাসে কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য একটি গঠিত তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটি ২৩ মার্চ আরএসআরএমের কারখানা পরিদর্শনে যায়। তখন কমিটির সদস্যরা কোম্পানিটির কারখানার সব কার্যক্রম বন্ধ দেখতে পান, যা ১০ এপ্রিল ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়। তার পর থেকে বিএসইসি বা ডিএসই কিংবা কোম্পানিটি থেকে আর কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে চট্টগ্রামভিত্তিক ইস্পাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির কাছে সোনালী ব্যাংক ২০১ কোটির বেশি ঋণের টাকা আদায়ের জন্য কারখানা ও ১০০ শতক জমি বিক্রির জন্য নিলামে তোলে।

এ ছাড়া কোম্পানিটির মূল প্রতিষ্ঠান রতনপুর গ্রুপের কাছে ১০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পাবে আর ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এসব ঋণ আদায়ের জন্য আরএসআরএমসহ তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অন্তত ২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের এক মামলা এবং জনতা ব্যাংকের দুই মামলায় আরএসআরএমের মালিকদের বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও।

১০ ব্যাংকের ২২০০ কোটি টাকার মামলায় রতনপুর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাকসুদুর রহমান, চেয়ারম্যান শামসুন নাহার রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই ছেলে মিজানুর রহমান ও মারজানুর রহমান, পরিচালক ইউনুস ভুঁইয়া এবং মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড: ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীরা এখনো পায়নি। ওই লভ্যাংশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩৫ টাকার ওপরে তোলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের মুলা ঝুলিয়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে কোম্পানির মালিকরা বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এরপর নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লভ্যাংশ ঘোষণা কার্যকর করার জন্য বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আহ্বান করতে কোম্পানিটিকে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর নির্দেশনা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। বিএসইসির নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটি হাইকোর্টে এজিএম আহ্বানের আবেদন দাখিল করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। হাইকোর্ট আবেদন মঞ্জুর করে এজিএম আহ্বানের আবেদন দাখিল করার নির্দেশনা দেয়, যা ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি কোম্পানিটি ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়।

এরপর কোম্পানিটি আর কোনো তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানায়নি। এর আগে কোম্পানিটির কোম্পানিটির মালিকানা যখন হস্তান্তর হয়, তখন কোম্পানির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান বিনিয়োগকারীদের অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। শেয়ারটি একসময়ে সোনার হরিণ হবে।

৩৫ টাকা যাওয়ার পর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলেছিল, এটি শেয়ারবাজারে অনন্য কোম্পানি হবে। এখন ঠিক উল্টোটি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এখন কোম্পানিটি ‘জালিয়াতি’ ও ‘ঠগবাজ’ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। একসময়ের সোনার হরিণ এখন বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড: ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের ভালোই লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০২০ সালে এসে কোম্পানিটি ফেঁসে যায়। ওই বছর কোম্পানিটি ব্যবসায় হঠাৎ মারাত্মক ভাটা দেখা দেয়। ফলে লভ্যাংশ ও মুনাফায়ও ধস নামে।

২০১৯ সালে কোম্পানিটির যেখানে শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা এবং লভ্যাংশ ছিল ১৫ শতাংশ, সেখানে ২০২০ সালে মুনাফা নেমে আসে ৮৬ পয়সায় এবং প্রথমে ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করলেও এজিএমে ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। কিন্তু এজিএম লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও লভ্যাংশের অর্থ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখনো বিতরণ করেনি কোম্পানিটি।

এদিকে ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণার পর পতনে থাকা কোম্পানিটির শেয়ারে এজিএমে ১ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার খবরে জোয়ার নেমে আসে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে শেয়ারটির দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, এর মাধ্যমে কোম্পানিটির মালিকরা বাজার থেকে শেয়ারটির দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

অন্যদিকে, ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ করেনি বলে কোম্পানিটি লভ্যাংশ বিতরণের কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদনও ডিএসইতে জমা দিতে পারেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ আগস্ট ডিএসই কোম্পানিটির কাছে লভ্যাংশ বিতরণের কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট তলব করেছে এবং বিষয়টি বিএসইসিকেও অবহিত করা হয়েছে।

এদিকে, ৩০ জুন ২০২২ সমাপ্ত অর্থবছরের কোনো প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি কোম্পানিটি। যে কারণে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। অর্থবছর শেষ হওয়ায় সামনে কোম্পানিটির লভ্যাংশ ঘোষণার কথা রয়েছে। কোম্পানিটির লুকোচুরির কারণে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির আসন্ন লভ্যাংশ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।