শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: সম্প্রতি পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতন দেখা গেছে। গত ৭ মার্চ এক দিনেই দরপতন হয়েছে ২.৭৪ শতাংশ। গত এক বছরে এটাই সর্বোচ্চ দরপতন। তবে হঠাৎ এত বড় দরপতনে সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ দরপতনের কারন কি আজও অজানা সবার মাঝে।তবে সাম্প্রতিক দরপতনের ইস্যু নিয়ে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসছে নানা রহস্য।

মুলত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নিজেরা বিনিয়োগ না করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দেয়। এর ফলে বাজার যখন খারাপ থাকে, তখন তারা নিজেদের পুঁজি সংরক্ষণ করার জন্য ফোর্স সেল দেয়। এতে করে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মুনাফাসহ তাদের পুঁজি ঠিকই তুলে নেয়। কিন্তু পথের ফকির হতে হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। আর বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।কিন্তু মূলধনের কতটুকু মার্জিন ঋণ দেয়া যাবে, এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। ফলে মূলধনের অর্থ নিজেদের পোর্টফলিওর চেয়ে মার্জিন ঋণ দিতেই আগ্রহী হয়ে উঠছে তারা।

যদি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ঋণ না দিয়ে নিজেরা বিনিয়োগ করতো, তাহলে লোকসানে তারা শেয়ার বিক্রি করতো না। ফলে বাজারে ফোর্স সেলও তৈরী হতো না। কিন্তু তারা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ না করে মার্জিন ঋণ দিতেই বেশি পছন্দ করে। যার কারণে বাজার একটু খারাপ হলেই তাদের ফোর্স সেলের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারাও যখন বাজারে সেল প্রেসার দেয় তখন বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিএসইসি বাধ্য হয়ে সাময়িক কিছু সান্তনা পুরস্কার নিয়ে হাজির হয়।

মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কেনার সম্পূর্ণ দায় বিনিয়োগকারীর। এক্ষেত্রে ঋণদাতা মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের কোনো দায় নেই। এ কারণে নিজস্ব পোর্টফলিওতে বিনিয়োগের চেয়ে ঋণ বিতরণে আগ্রহ বাড়ছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর। এভাবে বিনিয়োগকারীদের গলা কেটে মুনাফা লুটছে মার্চেন্ট ব্যাংক। অন্যদিকে ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলেও শেয়ারের দর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে গেলে গ্রাহকের অনুমোদন ছাড়াই বিক্রির ক্ষমতা রাখে মার্চেন্ট ব্যাংক। এভাবে ঝুঁকির দায়ে অংশীদার না হলেও মুনাফার পুরোটা নিতে পারে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান। ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ঋণের অর্থে শেয়ার কিনলে বিনিয়োগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু যথাযথভাবে বিশ্লেষণ না করে শেয়ারে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। শেয়ারে বিনিয়োগের বিপরীতে লাভ-লোকসান যা হোক, কোনো অবস্থাতেই মার্চেন্ট ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারের বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার।

বাংলাদেশের পুঁজিাবাজারে বর্তমানে ৬৬টি মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টির মালিকানা হচ্ছে ব্যাংকের। সাবসিডিয়ারি হওয়ার কারণে এর পোর্টফলিওর তথ্য ব্যাংককে জানাতে হয়। পুঁজিবাজারে থাকা ৩৫টি মার্চেন্ট ব্যাংকের পোর্টফলিও ও মার্জিন ঋণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ ৩৫টি মার্চেন্ট ব্যাংকের পুঁজিবাজারে পোর্টফলিও বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তাদের বিনিয়োগ সীমা হচ্ছে পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। কিন্তু তাদের মার্জিন ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এভাবে নিজস্ব পোর্টফলিওতে বিনিয়োগের চেয়ে তিনগুণ বেশি মার্জিন ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নীতিমালায় মার্চেন্ট ব্যাংককে বলা হয় মার্কেট ইন্টারমেডিয়টারি বা মার্কেট মেকার। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়।

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মার্চেন্ট ব্যাংকার ও স্টক-ব্রোকার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা, ২০০ অনুযায়ী, ‘পোর্টফলিও ম্যানেজার ইক্যুইটি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে চাইলে বিনিয়োগের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ তার হইবে।’

বিএসইসির দেয়া বিধিমালার ৩৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে, ‘প্রত্যেক মার্চেন্ট ব্যাংকার (পোর্টফলিও ম্যানেজার), উহার মাক্কেলকে মার্জিন ঋণ প্রদান করতে পারবে।’ সেখানে উল্লেখ থাকা শর্তে বলা হয়েছে, ‘মার্জিন ঋণ হিসাব পরিচালনার ঝুঁকি একান্তই গ্রাহকের। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পূর্বনির্ধারিত কোনো আয় প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকিতে পারিবে না।’

আরও উল্লেখ রয়েছে, ‘মার্জিন ঋণ হিসাবের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ইক্যুইটি কত হইবে, তা মার্চেন্ট ব্যাংকার (পোর্টফলিও ম্যানেজার ) নির্ধারণ করিবে।’ আর মার্জিন লোন বা ঋণ দেয়ার বিষয়ে বিধিমালায় উল্লেখ করা আছে, ‘মার্চেন্ট ব্যাংকার (পোর্টফলিও ম্যানেজার) কমিশন কর্তৃক সময় সময় নির্ধারিত হারে মার্জিন প্রদান করিবে।’ এখানে বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়েছে বিএসইসি। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মার্জিন ঋণ ও ইক্যুইটি অনুপাত বজায় রাখার জন্য ন্যূনতম মার্জিন প্রয়োগ-সংক্রান্ত নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ করিবে যাহাতে বাধ্যতামূলক বিক্রয় এড়ানো যায়।’

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘মার্চেন্ট ব্যাংক তার নিজস্ব সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ করতে পারবে। তার সোর্স অব ফান্ড কোথা থেকে, কত হবে, ঋণ করে আনবে কি না, এটা তার বিষয়। তার অর্থ পোর্টফলিওতে কত অংশ বা কতটুকু ইক্যুইটি বা ঋণ দেবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া নেই। এটি তাদের বিষয়; এটা নির্দিষ্ট করে দেয়াও ঠিক হবে না।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘মার্জিন ঋণ বাজারের জন্য যেমন ভালো, তেমন খারাপও। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ঋণ না দিলে বিনিয়োগকারীরা তাদের কাছে যায় না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে মার্জিন ঋণ দিতে হয়। এ বিষয়ে আমরা কোনো গ্রাহককে বাধ্য করছি না। আমরা মার্জিন ঋণকে উৎসাহিত করি না, মার্জিন ঋণকে নিরুৎসাহিত করি। এতে রিস্ক থাকে। কিন্তু আমি যদি মার্জিন ঋণ না দিই তাহলে গ্রাহক আসবে না, বড় আকারের পোর্টফলিওগুলো আসবে না। যারা মার্জিন ঋণ বেশি দিতে পারে, তাদের কাছেই গ্রাহকরা যাচ্ছেন।’

নিজস্ব পোর্টফলিওতে বিনিয়োগের চেয়ে মার্জিন ঋণে বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো এমন বিষয়ে মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘মার্জিন ঋণ মার্চেন্ট ব্যাংকের চেয়ে ব্রোকারেজ হাউস বেশি দিচ্ছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের কয়েকগুণ বেশি ঋণ দিচ্ছে ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান। বড় বড় ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের হিউজ পরিমাণ মার্জিন ঋণ রয়েছে। প্রতিদিন শীর্ষ ট্রেডার দেখলেই তা বোঝা যায়।

পুঁজিবাজারে মার্চেন্ট ব্যাংকের কাজ হচ্ছে নতুন ইস্যু আনা ও পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা এবং আন্ডাররাইটিং করা। অন্য কাজের মধ্যে রয়েছে করপোরেট পরামর্শ দেওয়া, ঋণ সিন্ডিকেশন করা, চলতি মূলধনের অর্থায়নের ব্যবস্থা করা, বিল ডিসকাউন্ট করা, ইজারা অর্থায়নের ব্যবস্থা করা, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, বাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে বিএসইসির এই হস্তক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়েছে। কিন্তু এভাবে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করা যাবে না। ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, জোড়াতালি দিয়ে পুঁজিবাজার স্বাভাবিক হয় না; স্থিতিশীলতা আসে না। বাজারকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে।’

তবে সাম্প্রতিক দরপতনের কারন কি খুঁজে কের করতে হবে। পাশাপাশি বিএসইসির উচিৎ ঠিক কি কারণে বাজারে এমন ফোর্স সেল হয়, অনুসন্ধান করে তা বের করা। এরপর আইন অনুযায়ী যথাবিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।