শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম: খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল তিনটি। এর মধ্যে একটি কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে ২০১৮ সালে। অন্য দুই কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়েছে গত ২৮ মে ও ৩১ মে। ফলে তিন মাস ধরে উৎপাদনে নেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি। সহযোগী একটি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, যার ওপর ভর করে কেপিসিএলকে আপাতত চলতে হচ্ছে।

যদিও নতুন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির চুক্তি নবায়নের চেষ্টা করছে কেপিসিএল। তবে তা অনুমোদন হলেও কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পাবে না কোম্পানিটি। বিদ্যুৎ কেনা হলে শুধু তার বিল দেয়া হবে। তাই ‘নো প্রডাকশন নো পে’ শর্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স নবায়ন হলেও তা বিনিয়োগবান্ধব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, বিনিয়োগকারীদের বিষয় দেখার দায়িত্ব তাদের না।

সূত্র জানায়, খুলনার খালিশপুরে প্রথম নির্মাণ করা হয় কেপিসিএলের প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ১১০ মেগাওয়াট বার্জ মাউন্টেন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবসায়ন হয় ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর। তবে সে কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ আর নবায়ন করেনি পিডিবি। খালিশপুরেই ছিল কেপিসিএলের দ্বিতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১১৫ মেগাওয়াট এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২৮ মে। আর যশোরের নোয়াপাড়ায় অবস্থিত ৪০ মেগাওয়াটের তৃতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ৩১ মে। ফলে ২৯ মে ও ১ জুন থেকে কেন্দ্র দুটি বন্ধ আছে।

এর আগেই ২৩ মার্চ কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদকে তলব করেছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সে সময় তাদের কাছে কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। আর কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হলে অবসায়ন প্রক্রিয়া কী হবে তাও জানাতে বলা হয়। যদিও এখনই কেপিসিএল বন্ধ করতে চাচ্ছে না কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এজন্য পিডিবিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির চুক্তির মেয়াদ নবায়নের আবেদন করা হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

সম্প্রতি বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে পিডিবি। এক্ষেত্রে শর্ত দেয়া হয়েছে, ‘নো প্রডাকশন নো পে’। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কেনা না হলে কোনো ধরনের বিল পাবে না কেপিসিএল। এছাড়া কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ন্যূনতম কোনো চার্জও থাকবে না। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এ শর্তে রাজি থাকলে চুক্তি নবায়ন করা হবে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, কেপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির চুক্তির মেয়াদ নবায়নের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আছে। তবে ‘নো প্রডাকশন নো পে’ শর্তে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে কোনো বিদ্যুৎ কেনা না হলেও বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেয়া হতো। তবে চুক্তি নবায়ন হলে এ ধরনের কোনো চার্জ পাবে না কোম্পানিটি। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ডার দেয়া হলে যে পরিমাণ কেনা হবে তার বিল পাবে।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ব্যাংকঋণ নেয়া হয়, যা পরিশোধের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়। তবে গত ১৫ বছরে কোম্পানিটি তার সব ঋণ পরিশোধ করে ফেলেছে। তাদের এখন আর কোনো ফিক্সড কস্ট নেই। তাই কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে না।

এ বিষয়ে কেপিসিএলের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা বলেন, ‘সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে। আবার খুলনা অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কম। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির চুক্তি নবায়নের আবেদন করা হয়েছে। তবে নবায়নের ইস্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ ও ব্যবস্থাপনা খরচ সরকারের পক্ষ থেকে না দেয়ার বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত হওয়ার সময়ে বলা যাবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

কেপিসিএল সূত্র জানায়, কেন্দ্র দুটির জন্য বার্ষিক বিদ্যুতের চাহিদা, উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা খরচের হিসাব-নিকাশ করছে কেপিসিএল। ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারের পক্ষ থেকে না পেলে ব্যবস্থাপনা খরচ কেমন পড়বে, সরকারের পক্ষ থেকে বার্ষিক কী পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা হতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পিডিবির সঙ্গে আলোচনা চলছে। দফায় দফায় চলছে বৈঠক ও তথ্য সংগ্রহ। সবকিছু নির্ভর করছে নতুন চুক্তি মূল্য নির্ধারণের ওপর।

এ বিষয়ে কেপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল মামুন এম আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘খুলনা ও যশোর অঞ্চলে গ্যাসের সংযোগ নেই। এ অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। এখনও লোডশেডিং হয়। কেপিসিএল এইচএফও (ফার্নেস অয়েল) প্রযুক্তির। বর্তমানে এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমেছে। কিন্তু চাহিদা মেটাতে সরকার অধিক খরচের ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়নের জন্য আবেদন করেছি। ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ সুপারিশ করেছে। কিন্তু এখনও কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। এর সঙ্গে অনেকগুলো সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ জড়িত। করোনা পরিস্থিতির কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে। নতুন শর্তের ফলে বিদ্যুতের ট্যারিফ বা দর নির্ধারণ এখনও হয়নি। এগুলো হওয়ার ওপর নির্ভর করছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কত দ্রুত চালু হবে।

যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে চুক্তি নবায়নের চেয়ে কোম্পানিটি অবসানকেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত মনে করছে পিডিবি। এ বিষয়ে সংস্থাটির হিসাব বিভাগ বলছে, ক্যাপাসিটি চার্জ না দিলে ‘নো প্রডাকশন নো পে’ শর্তে উৎপাদন চালিয়ে কোম্পানিটি আশানুরূপ মুনাফা করতে পারবে না। ফলে বিনিয়োগকারীদেরও ভালো মুনাফা দিতে পারবে না। বরং কেপিসিএলের প্রচুর রিজার্ভ রয়েছে। ওই অর্থে বিনিয়োগকারীদের পাওনা মিটিয়ে কোম্পানিটি অবসায়ন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

জানতে চাইলে কেপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল মামুন এম আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় কেপিসিএলের মুনাফা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ভাগ হয়। আমরা আশাবাদী, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সরকার এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হলেও কেপিসিএল কিন্তু সচল রয়েছে। কারণ ইউনাইটেড পায়রা পাওয়ার লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কেপিসিএলের। সেখান থেকেও রেভিনিউ আসবে।’

যদিও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব পিডিবির নয় বলে জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, কেপিসিএল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বলেই তাদের স্বার্থ দেয়ার দায়িত্ব পিডিবির না। তাদের বিষয়টি দেখবে বিএসইসি। বরং পিডিবি সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করবে।

এদিকে তিন মাস বন্ধ থাকলেও বিদ্যুৎ খাতের এ কোম্পানিটির শেয়ার বেড়েই চলেছে। কোম্পানির লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, ২৮ মে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর ছিল ৩১ টাকা ৯০ পয়সা। এরপর শেয়ারদর বাড়তে শুরু করে। ২৯ জুলাই দর গিয়ে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা ৫০ পয়সায়। আর গতকাল প্রতিটি শেয়ার কেনাবেচা হয় ৪২ টাকা ১০ পয়সায়। অর্থাৎ তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ১০ টাকা ২০ পয়সা বা ৩১ শতাংশ।

শেয়ারদর বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কেপিসিএলের কোম্পানি সচিব মো. মোজাম্মেল হোসাইন বলেন, ‘শেয়ারদর কেন বাড়ছে, তা আমাদের জানার কথা নয়। আমাদের কাছে কোনো সংবেদনশীল তথ্য নেই। কোনো তথ্য এলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’

যদিও এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই উচিত বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোনো কোম্পানি যদি উৎপাদনে না থাকে কিংবা কোনো কারণে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বিনিয়োগকারীর উচিত ওই কোম্পানির শেয়ার থেকে সরে আসা। কারণ তা না হলে এক সময় এটি তাদের বিপদের কারণ হতে পারে। কেপিসিএলের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। তাই এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আগে বিনিয়োগকারীদের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

উল্লেখ্য, কোম্পানিটি ২০২০ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ৩৪ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। এর আগের বছর তারা ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। সুত্র: শেয়ার বিজ