শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে ৬৬ কোম্পানির শেয়ার দামের সর্বনিম্ন সীমা বা ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেয়ায় দেশের শেয়ারবাজারে টানা বড় দরপতন দেখা দিয়েছে। আগের কার্যদিবসের মতো রোববার প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সবকটি মূল্য সূচকের পতনের পাশাপাশি কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।

শেয়ারবাজারে দেখা দেয়া এই দরপতনকে অযৌক্তিক বলছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পেনিক সেলের (আতঙ্কে বিক্রি) কারণে বাজারে টানা বড় দরতপন দেখা দিয়েছে। এই পেনিক সেলের পেছনের কারণ ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া এবং সরকার থেকে সর্বাত্মক লকডাউন দেয়ার ঘোষণা।

তারা বলছেন, বিএসইসি থেকে বারবার বলা হচ্ছে লকডাউনের মধ্যেও শেয়ারবাজারে লেনদেন চলবে। সুতরাং লকডাউন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দেয়া আতঙ্ক অযৌক্তিক। আর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সেটাও যুক্তি সংগত না। বিনিয়োগকারীদের উচিত বেশি দামে কেনা শেয়ার কম দামে বিক্রি না করা। বিনিয়োগকারীরা বিক্রির চাপ না বাড়ালে শেয়ারবাজারে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

এদিকে ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার আগে লকডাউনের মধ্যে টানা তিন কার্যদিবস শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স প্রায় আড়াই’শ পয়েন্ট বেড়ে যায়। আর বাজার মূলধন বাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার উপরে।

এ পরিস্থিতিতে বুধবার (৭ এপ্রিল) কমিশন সভা করে তালিকাভুক্ত ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইসের নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ও শেয়ারবাজারের উন্নয়নে প্রাথমিকভাবে এই কোম্পানিগুলোর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়েছে বলে জানায় বিএসইসি। বিএসইসির এই সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়। তবে বুধবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা।

এরপর বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজর খুলতেই ধস নামে। মাত্র দুই ঘণ্টার লেনদেনেই ডিএসই প্রধান সূচক ৮২ পয়েন্ট পড়ে যায়। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবি তুলেন। এ পরিস্থিতিতে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেয়া ৬৬ কোম্পানির বিষয়ে নতুন নির্দেশনা দেয় বিএসইসি। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এই ৬৬ কোম্পানির শেয়ার দাম একদিনে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কমতে পারবে। বিপরীতে দাম বাড়তে পারবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই সিদ্ধান্তও পতন আটকাতে পারেনি। রোববার (১১ এপ্রিল) শেয়ারবাজারে লেনদেনের শুরু হতেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানের দরপতন হতে থাকে। এতে ১৫ মিনিটেই ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ৮৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। লেনদেনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে পতনের ধারা

এতে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৯০ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ১৬৪ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৩৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯৫২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসইর শরিয়াহ্ সূচক ২০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১৭৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

বাজারটিতে দিনভর লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ২৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৪টির। আর ৫২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

মূল্য সূচকের পতনের সঙ্গে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণও আগের দিনের তুলনায় কমেছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৪৫৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৪৭৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনেদেন কমেছে ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

টাকার অঙ্কে ডিএসইতে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রবির ২৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ১৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিডি ফাইন্যান্স।

এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- পূরবী জেনারেল ইন্স্যরেন্স, প্রিমিয়ার ব্যাংক, এশিয়া প্যাসেফিক ইন্স্যুরেন্স, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স এবং বেক্সিমকো ফার্মা।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই কমেছে ২৪৭ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ১৯২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৩৯টির এবং ২৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘নতুন করে লকডাউন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখে দিয়েছে। এর সঙ্গে ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সব মিলে বিনিয়োগকারীদের পেনিক সেলের কারণে শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দিয়েছে।’ তবে আমি মনে করি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দেয়া এই আতঙ্ক যুক্তি সংগত না। কারণ বিএসইসি থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে লকডাউনে ব্যাংক খোলা থাকলে শেয়ারবাজারে লেনদেন চলবে। আর ব্যাংক বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নেয়া হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নেয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আমি কিছু বলবো না। তবে এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তা যুক্তি সংগত না। বিনিয়োগকারীদের উচিত এত পেনিক না হওয়া। যারা বেশি দামে শেয়ার কিনেছেন তাদের উচিত কম দামে বিক্রি না করা।’

তবে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছিল গত বছর করোনা মহামারিতে যেনে পুঁজিবাজারের ক্ষতি না হয়। আবার সেটিকে পরিবর্তন করে দেয়া হলো করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ে। লকডাউনের মধ্যে পুঁজিবাজার ভালো চলছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলে দিয়েছে।

‘ফ্লোর প্রাইস যেখন লেনদেন হচ্ছিল তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক ছিল না। ধারণা ছিল, এর নিচে না নামবে না, ফলে লোকসান হবে না। কিন্তু যখন ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হলো তখনই আতঙ্ক শুরু হলো। আর লোকসান হতে থাকল। তাই এ সময়ে ফ্লোর প্রাইসে ফিরে যাওয়াই ভালো হবে।’