শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশে কমে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানিকৃত কাঁচামালের স্বল্পতার কারণে চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে এক মাসের কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেড। এবার কারখানা বন্ধের মেয়াদ আরো বাড়িয়ে এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে কোম্পানিটির পর্ষদ।

ফলে উৎপাদিত সুতা বিক্রি করতে না পেরে ২০১৯ সালের জুন মাসে কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আলহাজ টেক্সটাইল। পরে একাধিকবার লে-অফের সময় বাড়ালেও এক বছরেরও বেশি সময়ে উৎপাদন চালু করতে পারেনি কোম্পানিটি। সহসাই উৎপাদনে ফিরে আসতে পারবে কি না, তাও নিশ্চিত করতে পারেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এবার আলহাজ টেক্সটাইলের পথে হাঁটছে রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেড।

কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে মাত্র এক বছর। এরই মধ্যে রিং শাইন টেক্সটাইলস কারখানা লে-অফ করেছে। সম্প্রতি লে-অফের মেয়াদও বাড়িয়েছে। ফলে কোম্পানিটি ঘিরে বিনিয়োগকারীদের শঙ্কাও বাড়ছে।বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানিকৃত কাঁচামালের স্বল্পতায় গতকাল সোমবার কারখানা এক মাসের জন্য লে-অফের ঘোষণা দেয় রিং শাইন টেক্সটাইলস।

পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় গত রবিবার পর্যন্ত কারখানা লে-অফ থাকবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। যদিও কোম্পানিটি যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করে, সেগুলোর এখন ভরা মৌসুম চলছে। এ সময়ে উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত অশনিসংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্লেসমেন্ট ও পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করার পর ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর স্টক এক্সচেঞ্জ লেনদেন শুরু হয় রিং শাইন টেক্সটাইলসের। গত বছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই বিতর্ক তৈরি রিং শাইনকে ঘিরে। কোম্পানিটিকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেও পড়েন সে সময়ের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেন।

রিং শাইন টেক্সটাইলস মূলত উলের সুতা ও কাপড় উৎপাদন করে থাকে। কোম্পানিটিতে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কর্মী রয়েছেন। ওয়ালমার্ট, এইচএনএম, নেক্সট, বেস্ট সেলারের মতো বিদেশি ক্রেতা রয়েছে রিং শাইনের। শীতকাল চলে আসায় রিং শাইনের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা থাকার কথা।

কিন্তু ভরা মৌসুমে কোম্পানিটি জানাচ্ছে, তাদের ক্রয়াদেশ কমে গেছে, কাঁচামালের স্বল্পতাও রয়েছে। করোনা সংকট কাটিয়ে যেখানে দেশের অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন উৎপাদন বন্ধ রেখেছে রিং শাইন। যদিও দেশে করোনা সংক্রমণের আগে থেকেই কোম্পানিটির পণ্য বিক্রিতে ধস নেমেছে। ২০১৯-২০ হিসাব বছরের শেষার্ধে কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে চলতি বছরের ২৫ মার্চ থেকে দেশের অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান টানা ৬৬ দিন লকডাউনের কারণে বন্ধ ছিল। সে সময় তৈরি পোশাক শিল্পপণ্য রপ্তানিতেও ধস নামে। তবে চলতি বছরের জুলাই থেকে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি বাড়তে থাকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি পণ্য রপ্তানি করে নিটওয়্যার খাত। কিন্তু চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে পূর্ব এশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলসের।

এর আগে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর সময়ে কোম্পানির পরিচালকরা পালিয়ে গেছেন এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসইসিকে দেওয়া এক চিঠিতে এমন তথ্য জানানোর পর থেকে গুজব তৈরি হয়। পরে কোম্পানির পরিচালকদের একটি অংশ দেশে ফিরে আসেন। তবে এখনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের বড় অংশই দেশের বাইরে রয়েছেন। রিং শাইন টেক্সটাইলসের প্লেসমেন্ট শেয়ারের একটি বড় অংশ একটি গ্রুপের নয়জন উদ্যোক্তা-পরিচালকের হাতে রয়েছে, যার পরিমাণ কোম্পানির মোট শেয়ারের প্রায় ২৭ শতাংশ। কোম্পানির পর্ষদ সভায় এই গ্রুপটিও আসতে চায় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে রিং শাইন টেক্সটাইলসের কোম্পানি আশরাফ আলী বলেন, ক্রয়াদেশের অভাব ও কাঁচামাল সংকটের কারণে উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন শুরু করতে পারব। এই খাতের অন্যরা যেখানে রপ্তানিতে ভালো করছে, সেখানে ভরা মৌসুমে রিং শাইনের উৎপাদন বন্ধ থাকার বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে আশরাফ আলী জানান, কোম্পানির পরিচালকদের একটি অংশ বিদেশে থাকলেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দেশে রয়েছেন।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটি ভালো আয় দেখালেও পরে তা আর ধরে রাখতে পারেনি। গত বছরের ১৫ অক্টোবর তালিকাভুক্তির পর ডিসেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শুরু হয় রিং শাইনের। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই কোম্পানিটি পণ্য রপ্তানিতে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। ২০১৯-২০ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) রিং শাইনের পণ্য বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমে যায়।

এ সময় পণ্য বিক্রি থেকে কোম্পানির আয় হয় ৮০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময় ছিল ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানির বিক্রি কমে যায় ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বিক্রিতে ধস নামায় এ প্রান্তিকে কোম্পানিটি ৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার পরিচালন লোকসানে পড়ে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ১৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল। কর পরিশোধের পর জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে কোম্পানির নিট লোকসান হয় ৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

অবশ্য ৯ মাসের হিসাবে ২৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা নিট মুনাফা রয়েছে। তবে মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিনের লকডাউনের কারণে এই মুনাফা শেষ পর্যন্ত কতটা থাকবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছে রিং শাইন টেক্সটাইলস। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১ টাকা ৭২ পয়সা, আগের হিসাব বছরে যা ছিল ১ টাকা ৯৯ পয়সা। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে কোম্পানির ৩১ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।