শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: করোনা ভাইরাসের প্রভাবে থমকে গেছে উন্নয়নের চাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের আতঙ্কে এসব প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ রয়েছে। গত ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ই দেশের চলমান প্রকল্পের কাজ ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করেছিল।

এখন সারা দেশ সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর কোনো প্রকল্পের কাজই হচ্ছে না। করোনার প্রভাবে অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলোয় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, কর্মকান্ড কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে বলা মুশকিল। কারণ শ্রমিক-কর্মকর্তারা করোনা আতঙ্কে কেউই কাজ করছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস শুধু উন্নয়নের গতি থামিয়ে দেয়নি, দেশের অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি সাধন করবে। এটি কীভাবে পুষিয়ে নেবে সেটা সময়ই বলে দেবে। কারণ ক্ষতির পরিমাণ কত বেশি হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সরকার এখন মানুষের জীবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। একই সঙ্গে শিগগিরই একটি উচ্চপর্যায়ে কমিটি করে ক্ষয়ক্ষতির পর উত্তরণের পথ বের করার কাজ শুরু করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড একেবারে থেমে গেছে বলা যায়। কারণ সংক্রমণের ভয়ে শ্রমিক ও কর্মকর্তা কেউই কাজ করছে না। এখন কবে নাগাদ এ কর্মকান্ড স্বাভাবিক হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস যেন ছড়িয়ে না পড়ে এজন্য সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

এটাই আমাদের এখন এক নাম্বার চিন্তা। উন্নয়ন কর্মকান্ড কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে বলা মুশকিল। কারণ করোনাভাইরাসের এ ধাক্কা অর্থনীতির বড় ক্ষতি সাধন করবে। এটা পুষিয়ে নিতে বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশও হিমশিম খাবে, এ ক্ষেত্রে আমরা তো অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৯ মে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে সরকার। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বাকি ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে পাওয়া ঋণে।

চলতি অর্থবছরের ৯ মাস পর বাস্তবায়নে গতি না থাকায় এডিপি কাটছাঁট করা হয় ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ টাকার পুরোটাই বৈদেশিক ঋণ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বছরের শুরুতে যা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা-ই রয়েছে। ফলে সংশোধিত এডিপির আকার দাঁড়ায় ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি আর বৈদেশিক ঋণ থেকে ৬২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে দেশে রাজস্ব আদায়ের হারও ব্যাপকভাবে কমে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কর্মকান্ড বন্ধ রয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমাণ হবে তা বলতে না পারলেও পরিমাণের অঙ্কটা যে অনেক বড় হবে সেটা বলায় যায়।

এ বিষয়ে গত বুধবার অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক আঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের শাটডাউনের কারণে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা কমছে। দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে আমাদের অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলোয়। রেমিট্যান্সের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব আসন্ন।

এদিকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক তহবিল গঠন করেছে। পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোর সহায়তার জন্য ৫ হাজার কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে আইএমএফ। যে অর্থের মধ্যে ১ হাজার কোটি ডলার পাবে স্বল্প আয়ের দেশগুলো। ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ উভয় সংস্থা থেকেই তাই বড় ধরনের সহযোগিতা আশা করছে। অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে এ দুই সংস্থাকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

ক্ষয়ক্ষতি ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের পরামর্শক ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উন্নয়ন কর্মকান্ডথেমে গেছে, এর মানে এগুলোর কাজ পিছিয়ে যাবে। ব্যয় বাড়বে। ফলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, করোনায় কী করণীয় তা নির্ধারণে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। কোন খাত এ করোনার দ্বারা বেশি প্রভাব পড়েছে সেটা বের করতে হবে আগে। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা দরকার। এর মধ্যে ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, অর্থনীতিবিদ, শ্রমিক প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর প্রতিনিধি করতে হবে।

করণীয় বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, করোনা থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিকে বাঁচাতে সরকারের উচিত একটি প্রতিনিধিত্বশীল কমিটি গঠন করা। যেখানে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। এরপর কমিটির সুপারিশ অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ, সেটি অর্জনে বাধাগ্রস্ত হবে।