শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশলী খাতের রেনউইক যগেশ্বরের কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নি:স্ব করেছে। বিনিয়োগকারীদের টাকায় ব্যবসা করলেও সমাপ্ত অর্থবছর শেষে বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দিচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রীয় কোম্পানিটি ঠিকই ব্যবসা করেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি পরিচালনা পর্ষদ ৩০ জুন ২০১৯ সমাপ্ত বছরে সংশ্লিষ্ট শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। তবে প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি ইপিএস হয়েছে ৭২ পয়সা। গত বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ৭০ পয়সা। বড় ইপিএস স্বত্বে নো ডিভডেন্ড ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

রেনউইক যগেশ্বরের কোম্পানির পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তবে রেনউইক যগেশ্বরের কোম্পানি লিমিটেডের ঘোষিত ডিভিডেন্ডে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন। ঘোষিত ডিভিডেন্ডের পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে একাধিক বিনিয়োগকারীরা। এদিকে রেনউইক যগেশ্বরের ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানি হওয়া স্বত্বেও নো ডিভিডেন্ড ঘোঘণা করায় সবার মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন সরকারসহ নীতি নির্ধারকীমহল যেখানে পুঁজিবাজার ভাল করার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় একটি কোম্পানি মুনাফা থাকা স্বত্বেও কিভাবে নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। এ কোম্পানির বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ কমিটি গঠনের মাঝে তদন্ত করা দরকার।

বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেছেন, রেনউইক যগেশ্বরের ঘোষিত ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করেছে। আর যদি প্রতারনা না করে তা হলে নো ডিভিডেন্ডের কারন কি? যেখানে কোম্পানি লাভে রয়েছে সেখানে ডিভিডেন্ড না দেওয়ার কোন কারন দেখা যাচ্ছে না। নামমাত্রা লাভ করে ও কোম্পানিগুলো বছর ষে ডিভিডেন্ড দেয়। এ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের শাস্তির দাবী জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা ।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৪.২১ টাকা। তারপরেও কোম্পানিটির পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা শেয়ারবাজারের চলমান মন্দাবস্থায় কারও কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৪.২১ টাকা হিসেবে মোট ৮৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুনাফা হয়েছে।

এক্ষেত্রে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের তুলনায় বড় মুনাফা হওয়া সত্তে¡ও শেয়ারহোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ। ফলে মুনাফার শতভাগ কোম্পানির রিজার্ভে যোগ হবে। এর আগের বছর কোম্পানিটির পর্ষদ ৫.৩১ টাকা ইপিএসের বিপরীতে ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। রাষ্ট্র মালিকানাধীন রেনউইকে সরকারের ৫১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিটির ২ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে ৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার ঋণাত্মক রিজার্ভ রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে আরো দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিটি ধারাবাহিক মুনাফা করছে। গত পাঁচ বছরে ধরে কোম্পানিটির মুনাফা গতানুগতিক রয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানিটি ২০১৫সালে মুনাফা করে ৭৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৮ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৬ সালে মুনাফা করে ৯৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৯ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৭ সালে মুনাফা করে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৪ টাকা ১৭ পয়সা।

কোম্পানিটি ২০১৮ সালে মুনাফা করে ১ কোটি ৬ লাখ ১১ হাজার ৪৭০ টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৫ টাকা ৩১ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৯ সালে মুনাফা করে ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৪৫ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৪ টাকা ২১ পয়সা। এছাড়া কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি সম্পদ ২০১৮ সালে ছিল২৭ টাকা ২৩ পয়সা, তেমনি ২০১৯ সালে শেয়ার প্রতি সম্পদ ৩০ টাকা ৬৬ পয়সা।

এ ব্যাপারে বিডি ফাইন্যান্সের বিনিয়োগকারী হুমায়ন কবির বলেন, পুঁজিবাজারে এমনই স্মরনকালের ধ্বসে সাধারন বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিনিয়োগকারীরা রাষ্ট্রীয় কোম্পানির প্রতি যদি আস্থা না থাকে তা হলে পুঁজিবাজারে কিসের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করবে। রেনউইক যগেশ্বরের মত সরকারী কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করছে। এ কোম্পানির এমডি থেকে পরিচালনা পর্যদের সকলের শাস্তি হওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে বিনিয়োগকারী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, রেনউইক যগেশ্বরের নো ডিভিডেন্ডের নামে আমাদের নি:স্ব করছে। লাভজনক একটি কোম্পানি নো ডিভিডেন্ড দেয় কিসের ভিতিতে। কোম্পানিটি নো ডিভিডেন্ডের অদৃশ্য কারণ খতিয়ে দেখা উচিত।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, রেনউইক যগেশ্বরের ৪.২১ টাকা ইপিএস শর্তেও নো ডিভিডেন্ড পরিচালকদের জঘন্যতম কারসাজি ছাড়া আর কিছু না। এমন হীনমানষিকতা এবং হীনকর্মকান্ডের জন্য জুন ক্লোজিং সকল শেয়ারই কমবেশী আক্রান্ত হবে। ডিভিডেন্ড প্রদানে সঠিক কোন নিয়মনীতি না থাকায় পরিচালকরা নিজেদের হীন স্বার্থে ইচ্ছামত ন্যুনতম ডিভিডেন্ড বা নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এসব অনিয়ম দেখেও বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করছে। রেনউইক যগেশ্বরের নো ডিভিডেন্ড দিয়ে শেয়ারটাকে জেডে স্থানান্তর পরিকল্পিত, উদ্দেশ্য প্রনোদিত এবং হাজার হাজার বিনিয়োগকারীদের সর্বশান্ত করে কোম্পানিটি কুট কৌশলে লাভবান হওয়ার নোংরা প্রচেস্টারই অংশ মাত্র। তাই এইসময়ে জুন ক্লোজিং শেয়ার বাই কারাটাও খুব বেশী রিস্কি হতে পারে। আশা করি সবাই পরিস্থিতি বিবেচনা করে, খুব ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিবেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, পুঁজিবাজারের এ দু:সময়ে রেনউইক যগেশ্বরের মতো সরকারী কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করছে। বিনিয়োগকারীরা স্মরনকালের ধ্বস কাটিয়ে উঠতে না উঠতে নো ডিভিডেন্ড ঘোষনায় মেতে উঠছে।

যেখানে সরকার পুঁজিবাজারের জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করছে সেখানে রেনউইক গগেশ্বর নো ডিভিডেন্ড দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। এটা বাজারের জন্য খারাপ দিক। বিনিয়োগকারীরা অনেক আশা নিয়ে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকেন। নো ডিভিডেন্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সে আশা নিরাশ হয়ে যায়। ভবিষ্যতে কোম্পানিটি কেমন করবে সেটা নিয়েও আমাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে আমি তাদের যথাযথ শাস্তি দাবি করছি।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, রেনউইক যোগেশ্বরের পর্ষদ ‘নো ডিভিডেন্ড’ এর জন্য শাস্তি দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে তারা কেনো খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। যা মন চেয়েছে, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শেয়ারহোল্ডাররা। তাদের এমন সিদ্ধান্তে শেয়ারটির দর প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। লভ্যাংশ নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। যাতে পরিচালকেরা লভ্যাংশ নিয়ে খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নিতে না পারে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. শাহজাহান মিনা বলেন, রেনউইক যোগেশ্বরের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি। এ জাতীয় কোম্পানি যদি পুঁজিবাজারে সাধারন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ না দেখে তাহলে কারা দেখবে। লাভজনক কোম্পানি নো ডিভিডেন্ডের সিদ্ধান্তে আমি নিজেও হতবাক। তিনি বলেন, এর ম্যানেজম্যান্টও ফেয়ার না। যাতে বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়েছে।

তিনি বলেন, লভ্যাংশ না দিয়ে পরিচালকদের কারসাজি শেয়ারবাজারে বিদ্যমান। তারা লভ্যাংশ না দিয়ে শেয়ার দর ফেলে দেয়। পরে নিজেরা শেয়ার সংগ্রহ করে। এবং পরবর্তী বছরে লভ্যাংশ দিয়ে শেয়ার দর বাড়িয়ে বিক্রয় করে দেয়। এক্ষেত্রে বিএসইসির দায়বদ্ধতা আছে। তাদের কাজ হলো শেয়ারবাজারকে সুস্থ রাখা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষন করা।

ডিএসইর এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেনউইক যোগেশ্বরের পরিচালনা পর্ষদ লভ্যাংশ বিষয়ে অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কারও পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব না। তাই বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) খতিয়ে দেখা উচিত। একইসঙ্গে এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কোন সরকারী হউক আর বেসরকারী কোম্পানি হউক এমনটি করার সাহস না দেখায়।

এ বিষয় রেনউইক যগেশ্বরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াদুদ আমীন সাথে বার বার যোগাযোগের টেষ্টা করলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।