শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা:  বিনিয়োগ মন্দায় চলছে দেশের আর্থিক খাত। খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অধিকাংশের মুনাফায় টান পড়েছে। তারপরেও কিছু ব্যাংক মুনাফা কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দেখিয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। মাঝে মাছে বাড়ছে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম, ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন গ্রাহক। এসবের বিরুদ্ধে এবার তদন্তে নামবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবে ব্যাংকিং খাতের যেকোনো ধরনের অনিয়ম বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যেসব ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফার উল্লম্ফন দেখিয়েছে তাদের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তালিকাভুক্ত এসব ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে অসংগতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহক বাড়াতে পরিচালন মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে পারে। তবে পরবর্তী ঋণ রিকভারি করার সময় তা ধরা পড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

এদিকে ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি থাকে ওই ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত মুনাফা তত কমে যায়। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা মেনে চললে কোনো ব্যাংকের বেশি মুনাফা হবার কথা নয়। এ ছাড়া ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য আয় আসে এলসি কমিশন থেকে।

পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলে ব্যাংকগুলো উলে­খযোগ্য মুনাফা করে। কিন্তু বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটের পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। আমানতকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ, খেলাপি ঋণের প্রভিশন ও প্রাপ্য কর পরিশোধের পর এসব ব্যাংকের অতিরিক্ত মুনাফার আসল চিত্র ফুটে উঠবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটাকে মুনাফা না বলে ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের আংশিক চিত্র বলা যায়। উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না।

সূত্রে জানা গেছে, এসব ব্যাংকের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় এসব ব্যাংকের অস্বাভাবিক মুনাফা বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর অভিযোগ প্রমাণিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত ৭ ব্যাংকের চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি- জুন ১৮) ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা কৃত্রিম বা অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ৫টি ব্যাংকের লোকসানকে আড়াল করে কৃত্রিম মুনাফা দেখানো হয়েছে। আর ২টি ব্যাংকের মুনাফা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এই কৃত্রিম মুনাফা দেখানোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

প্রদত্ত ঝুকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতিবাবদ (প্রভিশনিং) ব্যয় না দেখিয়ে এই কৃত্রিম মুনাফা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা চলতি বছরের প্রথমার্ধের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রথমার্ধে কৃত্রিম ও বেশি মুনাফা দেখানো তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো হচ্ছে: এবি ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে নতুন করে প্রভিশনিং ঘাটতিতে পড়েছে। আর প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশনিং ঘাটতি বেড়েছে।

ওই সময় ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় বা যথাযথ সঞ্চিতি গঠন না করে বা ব্যয় না দেখিয়ে কৃত্রিম মুনাফা দেখিয়েছে। এবি ব্যাংকের চলতি বছরের প্রথমার্ধে প্রভিশনিং ঘাটতির মাধ্যমে ১৪৭ কোটি টাকা বেশি মুনাফা দেখিয়েছে। এছাড়া সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৩৬৮ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক ২১ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১০৬ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ৩১৮ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৬০ কোটি টাকা ও প্রিমিয়ার ব্যাংক ৩৭ কোটি টাকার কৃত্রিম মুনাফা দেখিয়েছে।

এদিকে এবি ব্যাংক চলতি বছরের প্রধমার্ধে প্রভিশনিং ঘাটতির মাধ্যমে শেয়ারপ্রতি ১.৫৫ টাকা লোকসানের পরিবর্তে ০.৩৯ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে। এছাড়া সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক শেয়ারপ্রতি ৪.১২ টাকা লোকসানের পরিবর্তে ০.৪১ টাকা মুনাফা, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ০.৩৩ টাকা লোকসানের পরিবর্তে ১.৫২ টাকা মুনাফা, ন্যাশনাল ব্যাংক ০.৬৪ টাকা লোকসানের পরিবর্তে ০.৫৬ টাকা ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১.৫৪ টাকা লোকসানের পরিবর্তে ০.৫০ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে। আর আইএফআইসি ব্যাংক ০.২৭ টাকার পরিবর্তে ০.৪৩ টাকা ও প্রিমিয়ার ব্যাংক ০.৪৬ টাকার পরিবর্তে ০.৯৭ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে।

এর আগে প্রভিশনিং ঘাটতির মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখিয়েছে। তবে চলতি বছরের ৩০ জুনে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সেই প্রভিশনিং ঘাটতি কমে এসেছে। এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঘাটতি ২৭৫ কোটি টাকা থেকে কমে প্রায় ৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রভিশনিং ঘাটতি ৭৯ কোটি টাকা থেকে ৩৭ কোটি টাকা বেড়ে ১১৬ কোটি টাকায় ও ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা থেকে ৩১৮ কোটি টাকা বেড়ে ৪৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।