BANK LAGOএইচ এম তারেকুজ্জামান ও আরিফুল ইসলাম, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন পর ব্যাংক খাতের শেয়ারে সুবাতাস বইতে শুরু করছেন। দীর্ঘদিন পর ব্যাংক খাতের শেয়ারে দর বাড়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাছাড়া আজ সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে বাজারে ব্যাংক খাতের শেয়ারের আধিপত্য বিস্তার ছিল। ঘুরে ফিরে ব্যাংক খাতের শেয়ার টপটেনে অবস্থান ছিল।

তেমনি ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রতি আস্থা ফিরতে শুরু করেছে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা নতুন করে ব্যাংক খাতের শেয়ারের দিকে ঝুঁকছেন।

এছাড়া দীর্ঘদিন পর বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ার দর।  সাধারনত তিন কারনে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। গতকাল পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা এমনই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের প্রতিবেদকের কাছে।

তারা বলেন, পুঁজিবাজারের গতি ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকের খাতের শেয়ারের প্রতি কদর বাড়ছে। সামনে আরো বাড়বে। কারণ অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর কাছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রতি রয়েছে ব্যাপক আস্থা। যদিও পুঁজিবাজারের মন্দা সময়ে এ খাতের প্রতি আস্থা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে আবার এ খাতের শেয়ারের প্রতি ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা জানান, পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ পুঁজিবাজার উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি বাড়াতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এ খাতের শেয়ার এখনো কিছুটা বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত। পাশাপাশি রয়েছে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ আস্থাভাজন।

তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। তারা আরো জানান, ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন এবং শেয়ার সংখ্যা বেশি। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এ খাতকে বিনিয়োগ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আবার কোম্পানিগুলোর লেনদেন ও দর ওঠানামা অনেকটাই স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। অন্যান্য কোম্পানির মতো ঢালাওভাবে এ খাতের শেয়ার দর উত্থান-পতন হয় না। কয়েক বছর ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বেশি মুনাফা দিতে পারেনি এ খাতের কোম্পানিগুলো। তারপরও অন্যান্য খাতের চেয়ে ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। পুঁজিবাজারের পতনের সময় বিনিয়োগকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে এ খাতে বাজার সেলপ্রেসার বেশি হয়েছিল। পাশাপাশি প্রফিট টেক করেছে, যার প্রভাব পড়েছে পুরো খাতের ওপর। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাজার স্বাভাবিক গতিতে চলছে। বাজার একটানা যেমন বাড়ছে না, তেমনি বাজার একটানা দরপতন ঘটছে না। এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাংক খাতের শেয়ার ধারণ বা বিনিয়োগ করতে হবে। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়লে পুরনো লেনদেনের চমকে ফিরে আসবে বলে জানান তারা।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, বছর শেষে সোমবার পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ৩০ কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২৮ টি কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে। এছাড়া অপরিবর্তিত ছিল ২ কোম্পানির শেয়ারের দর। শতাংশের হিসাবে যার পরিমাণ ৯৫ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এই বছর ব্যাংকের শেয়ারের দর বৃদ্ধির প্রধান কারণ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সমন্বয় ও অধিকাংশ ব্যাংক কোম্পানি মুনাফায় ফেরা। এই দুই কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এই খাতের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। এবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সময় ও বিশেষ সুযোগে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আইনী সীমায় নামিয়ে আনে ১৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।

এতে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে আরও ১৫শ’ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ওই ব্যাংকের আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন আর্নিংসের ২৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। ১৩টি ব্যাংকের এ সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুযোগের কারণে সবকটি ব্যাংক ২১ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের বিনিয়োগ সমন্বয় করে। এছাড়া আগের তুলনায় লাভে ফিরেছে অধিকাংশ ব্যাংক। যাতে এই খাতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।

বছরের সার্বিক চিত্রে দেখা যায়, বছরজুড়ে অল্প অল্প হলেও বেশিরভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়ছে। ফলে এই খাতে আবারো সুদিন ফিরছে এমন মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত চলতি বছর ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলো মুনাফায় রয়েছে যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। ফলে বাড়ছে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দর।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের কিছু সমস্যা ছিল তবে ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগ সমন্বয় করায় এখন সে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আশা করছি বিনিয়োগকারীদের এখন এই শেয়ারের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। তবে এই ক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। তারা যদি এসব শেয়ারের দিকে নজর দেন তবেই খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, এ বছর বেশিরভাগ ব্যাংক মুনাফায় ফিরেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যাংকগুলোর আমানত বাবদ সুদ কমা। গত বছরের তুলনায় এ বছরের আমানতের সুদ বাবদ ব্যয় কমেছে। ফলে ব্যাংকের মুনাফা বাড়ছে। যার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের এক পরিচালক জানান, ব্যাংক খাতের শেয়ার সংখ্যা বেশি। পুঁজিবাজারে সব ব্যাংকের শেয়ার দর সামান্য বাড়লে পুরো বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকে। অন্য খাতের তুলনায় বছরজুড়ে এ খাতের শেয়ারের প্রতি তাদের চাহিদা বেশি দেখা গেছে। সেই সঙ্গে এসব শেয়ারের দরও ছিল স্থিতিশীল পর্যায়ে। বছর শেষেও যার প্রতিফলন দেখা গেছে।

ব্যাংকগুলোর মুনাফার দিকে তাকালে দেখা যায় চলতি বছরের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের নিট মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ও খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল বেশি হওয়ার কারণে মুনাফা বেড়েছে।

ব্যাংকগুলোর প্রকাশিত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ২০টির নিট মুনাফা ও ইপিএস বেড়েছে। কমেছে ৯টির। একটির অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে ১৫ ব্যাংকের নিট মুনাফা ও ইপিএস বেড়েছে। কমেছে ১৪টির। একটির ইপিএস অপরিবর্তিত রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী যেসব ব্যাংকের নিট মুনাফা ও ইপিএস বেড়েছে সেগুলো হলো সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

এক্ষেত্রে ইপিএস অপরিবর্তিত রয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের। বিপরীতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় নিট মুনাফা ও ইপিএস কমেছে প্রাইম ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, পূবালী, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, ব্যাংক এশিয়া, আল-আরাফাহ্, ঢাকা, ইসলামী, সাউথইস্ট, ওয়ান, শাহজালাল, উত্তরা, এনসিসি এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাত বলা হয়ে থাকে পুঁজিবাজারের সব চেয়ে শক্তিশালী খাত। এক সময় পুঁজিবাজারে মোট লেনদেনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ থাকত এই খাতের অবদান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি বদলে গেছে। লেনদেনে ব্যাংকের অবদান নেমে এসেছে ১০ শতাংশের নিচে। ব্যাংকিং খাতে হলমার্কসহ নানা অনিয়ম সর্বোপরি রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনায় সাধারণ গ্রাহকের যেমন ব্যাংকের প্রতি আস্থা কমেছে। তবে এই পরিস্থিতি অনেকটা কেটে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।