পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা আটকে আছে পাঁচ ইস্যুতে!
শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারের টালমাতাল পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা স্বস্তি ফিরে পাচ্ছেন না। দেশের দুই পুঁজিবাজারে একদিকে রয়েছে তারল্যের সঙ্কট অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। বাজার উন্নয়নে সকারের নেওয়া নানা উদ্যোগও কাজে আসছে না। ফলে দীর্ঘ দিন পুঁজিবাজারে চলছে অস্থিরতা। আর বর্তমান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট ও তারল্য সংকটের কারনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না।
বর্তমান বাজার নিয়ে সরকারসহ নীতি নির্ধারকরা বাজার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। তবে গত চার কার্যদিবস ধরে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে বাজার আগাতে শুরু করলেও লেনদেন বাড়ছে না। সুচকের সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনের গতি বাড়তে থাকলে বাজার দ্রুত এগাতো বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বিনিয়োগ করতে পারছে না পুঁজিবাজারে। ফলে অর্থ সঙ্কটে ভুগছে পুঁজিবাজারর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তার কারনে ১০টি ব্যাংক এক্সপোজার সমন্বয়ের পর বিনিয়োগের জন্য বাড়তি যে সুযোগ পাচ্ছে সেই যদি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তাহলে দ্রুত পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবো।
একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলেন, বিনিয়োগের জন্য প্রাপ্ত টাকা ব্যাংকগুলো যাতে অবশ্যই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এ ব্যাপারে শুধু মৌখিক নির্দেশনা নয় প্রয়োজনে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে আইন করে দেয়া উচিত। যাতে কোনো ব্যাংক এই টাকা পুঁজিবাজারের বাইরে বিনিয়োগ করতে না পারে।
বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকমকে বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দ্রুত লেনদেন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারন গত চার কার্যদিবস ধরে বাজার একটা নিদিষ্ট গতিতে চলছে। এ গতি ধরে রাখতে পারলে বাজার স্বাভাবিক হবে। এছাড়া ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে কি করবে না তা তাদের ব্যাপার। তারা যেখানে বিনিয়োগ করে বেশি প্রোফিট পাবে সেখানেই তাদের বিনিয়োগ করা উচিত।
শেয়ার বাজারকে যদি তারা প্রোফিট্যাবল জায়গা মনে করে তাহলে এখানে করবে নচেৎ অন্য কোথাও। কারন ব্যাংকগুলোকে যদি এভাবে বিনিয়োগে বাধ্য করা হয় আর বছর শেষে লোকসান দেয় সেক্ষেত্রে আলটিমেটলি বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই শেয়ার বাজারকে চলতে দেয়া উচিত তার আপন গতিতে।
অন্যদিকে পুঁজিবাজারের গত ছয় বছরে ধস পরবর্তী বাজার রক্ষায় নীতিনির্ধারক মহল থেকে অসংখ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখেনি। আর সফলতা না আসার কারণেই পতনের বৃত্ত থেকে বাজারকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। মূলত একশ্রেণীর বিনিয়োগকারীর স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগের কারণেই আস্থার অভাব বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, একশ্রেণীর স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারী আছে যারা বারবার উর্ধমুখী বাজারের সুবিধা নিয়েছে। আবার সুযোগ বুঝে শেয়ার বিক্রি করে নিস্ক্রিয়ও হয়ে গেছে। এ ধরনের স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের কারনেই বাজারে স্বাভাবকি আচরণ স্থায়ী হচ্ছে না। পাশাপাশি তারল্য সংকটের কারনে বাজার সোজা হয়ে দাঁড়াতো পারছে না।
আর যেহেতু বাজার স্বাভাবিক না হলেও তাদের মুনাফায় ঘাটতি পড়ছে না তাই ইচ্ছে করেই তারা বাজারকে নিম্নমুখী প্রবণতায় রাখতে চাচ্ছে। আর এতে করে বাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বারবার চিড় ধরেছে।
এ পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘ ছয় বছর অতিক্রম করেছে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ ৬ বছর একটি স্থিতিশীল বাজার দেখার অপেক্ষা থাকলেও তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। এ পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘ ৬ বছর অতিবাহিত করেছে বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে ২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে কয়েকবার বাজারে উত্থান প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এর এ উত্থান প্রবণতা দেখে বিনিয়োগকারীরা প্রতিবারই লোকসান কাটনোর প্রত্যাশা করেছেন। অনেকে নতুন করে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের লোকসান কাটানোর চেষ্টাও করেছেন; কিন্তু কিছুদিন বাজার স্থিতিশীলতার আভাষ দিয়ে আবার পতনে রুপ নিয়েছে।
সে সময় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমান আরো বেড়েছে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে পুঁজির পাশাপাশি কমেছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা। যা বর্তমানে তলানীতে এসে ঠেকেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এমন সঙ্কটে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও।
বারবার আহ্বান করা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে সক্রিয় হচ্ছে না প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। তাদের নিস্ক্রিয়তার কারণে বাড়ছে না লেনদেনের পরিমান। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা বাড়ছে। অপরদিকে তারল্য সঙ্কট নয় ধারাবাহিক দরপতনের কারনেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এমন কথা বলছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আর বাজার স্থিতিশীল না হলে নতুন করে বিনিয়োগের ঝুঁকিতে যেতে চাইছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট আর আস্থাহীনতার কারনে দৈনিক লেনদেনের পরিমান নেমে এসেছে ৩’শ কোটি টাকার নিচে। যেখানে দৈনিক ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে হতে দেখা গেছে সে তুলনায় এখনাকার লেনদেন অনেক কম।
আর ধারাবহিকভাবে লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিস্ক্রিয়তাকে দায়ী করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সংকটের সময় পুঁজিবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন মহল থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সেগুলো আর বাস্তবায়ন করা হয় না।
বারবার এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান বাজার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা সংকট কাটলে হলে বাজার টানা স্থিতিশীল থাকতে হবে। তেমনি লেনদেনের পরিমান দ্রুত বাড়তে হবে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সীমার বাইরে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর পর্যাপ্ত পরিমাণ শেয়ার বাজারে না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের মতে, বাজারে মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বহুজাতিক বা বহুজাতিক মালিকানাধীন। কিন্তু কোম্পানিগুলো শেয়ারের চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীদের অসম্পৃক্ততা, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফার সংকট, দেশীয় কোম্পানিগুলোর মুনাফার অপ্রতুলতা ও আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিকে লোকসানি করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের পাশাপাশি প্রয়োজন বাজার উন্নয়নে যুগোপযোগী পদক্ষেপ।
ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন পরবর্তী নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়হীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তায় ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী হয়েছিল পুঁজিবাজারের সার্বিক লেনদেন। এ সময় বাজারের গড় লেনদেন ৩০০ কোটির ঘরে নেমে আসে।
প্রথমত, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ধস : বিগত ৩ বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির মুনাফা কমেছে ধারাবাহিকভাবে। এর মধ্যে বিগত বছরে তালিকাভুক্ত ফারইস্ট ফাইন্যান্স, সুহ্রদ ইন্ডাস্টিজ, প্রাইম ফাইন্যান্স, কোম্পানিটি ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফার ভাটায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, দেশীয় কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে অস্বচ্ছতা : তাদের মতে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতাকে পুঁজি করে আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফার পরিমাণ কম দেখাচ্ছে দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর নিম্নমুখী প্রবণতায় নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে তালিকাভুক্ত বেশকিছু কোম্পানি। এছাড়াও অন্যান্য কোম্পানিগুলোর মুনাফার চিত্র নিম্নমুখী হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মনে কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থা সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
তৃতীয়ত, মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো শেয়ারের চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি : এদিকে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর অধিকাংশেরই শেয়ারের চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা উচ্চমূল্যে শেয়ার ক্রয় করতে পারছেন। অন্যদিকে, কম মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর অধিকাংশেরই উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ শেয়ার না থাকলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
চতুর্থত, নতুন বিনিয়োগকারীর সম্পৃক্ততা কম : বাজারের ধারাবাহিকতার পেছনে বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু ২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিক সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হলেও সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা না থাকায় বাজারে লেনদেনের গতিশীলতা বাড়ছে না। অন্যদিকে, বাজারের মধ্যে ধারাবাহিক অস্থিরতা বিরাজ করায় নতুন বিনিয়োগকারীরাও বাজারের ফিরছে না।
পঞ্চমত, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার অভাব রয়েছে। আমাদের দেশের বর্তমান আইপিও প্রক্রিয়া (ডিসক্লোজার) বিভিন্ন সময় নানা মহলের কাছে আলোচনায় এসেছে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলেও পরবর্তীতে তাদের মুনাফা কমছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাই, ডিসক্লোজার ভিত্তিক আইপিও অনুমোদনের পরিবর্তন এনে মেরিট ভিত্তিক আইপিও অনুমোদন দেওয়া উচিত।
ডিএসইর সাবেক সদস্য আহমেদ রশিদ লালী বলেন, পুঁজিবাজার ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারের নমনীয় মনোভাব জরুরি। সরকার পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নিলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। কারণ, নতুন আইন তৈরি এবং আবারো ওই আইনগুলোর সংশোধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। শুধু আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করলেই বাজারের স্থিতিশীলতা বা লেনদেনের গতি বাড়বে না। এজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী কিছু সিদ্ধান্ত।