sampur sugerশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি চিনিকলগুলো মুনাফা করলেও বছরের পর বছর লোকসান গুনছে দেশের সরকারি ১৫টি চিনিকল। সরকারি চিনিকলগুলোর বছরের পর বছর লোকসানের পেছনে ৬টি কারণ শনাক্ত করেছে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন। সম্প্রতি চালানো এক সমীক্ষায় কমিশন লোকসানের কারণ হিসেবে সরকারি চিনিকলগুলো উৎপাদন খরচ বেশি, সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লোকবল নিয়োগ দেওয়া ও সিবিএ গঠন করাকে দায়ী করেছে।

পাশপাশি আখের অভাবে সারাবছর কাজ না থাকায় বসিয়ে বসিয়ে অতিরিক্ত লোকজনকে বেতন-ভাতা দেওয়া ও ব্যাংকঋণের ওপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়াকে দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর লোকসান প্রাক্কলন করা হয় ৪০১ কোটি টাকা। এর আগে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো ৩১০ কোটি টাকা ও ২০১১-১২অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ২৯০ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর সরকারি চিনিকলগুলোয় লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩১৩ কোটি টাকা।

বিএসএফআইসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে সরকারি মালিকানাধীন ১৫টি চিনিকল রয়েছে। এগুলো হলো—জিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেড, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লিমিটেড, শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড, পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড, নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর সুগার মিলস লিমিটেড, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড, জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড, ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড, রাজশাহী সুগার মিলস লিমিটেড এবং কেরু অ্যান্ড কোং সুগার মিল। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ থেকে ১৯৬০-এর মধ্যে।

এদিকে, বেসরকারি ৬টি চিনিকলের মধ্যে ৫টি চিনিকল মুনাফা করছে। এই ৫টি চিনিকল হলো—বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, নরসিংদীর পলাশে দেশবন্ধু সুগার মিলস, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ইউনাইটেড সুগার মিলস ও আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিল। বেসরকারিখাতে স্থাপিত ৬টি সুগার রিফাইনারির মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত পারটেক্স সুগার মিল বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, সরকারি ১৫টি চিনিকল যে বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, তার মূল কারণ ৬টি। এর মধ্যে প্রথম কারণ হলো—কোনও কারণ ছাড়াই এই কারখানাগুলোয় উৎপাদিত চিনির ব্যয় বেশি। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় এ মিলগুলোয় উৎপাদিত চিনির দামও বেশি। তাই বাজারে তা বিক্রি হয় না।

বিক্রি না হওয়ায় দিনের পর দিন মূলধন আটকে যাচ্ছে। আর মূলধন আটকে গেলে বাড়তে থাকে ব্যাংক ঋণের সুদের পরিমাণ। তৃতীয়ত, সরকারি চিনিকলগুলোয় ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল আখ পাওয়া যায় না। আখের অভাবে চিনিকলগুলো বন্ধ থাকে মাসের পর মাস। চিনিকল বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে সারাবছরের বেতনভাতা দিতে হয়। উৎপাদন নেই, কিন্তু বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। ফলে লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে।

চতুর্থ কারণ হলো—উৎপাদিত চিনি বিক্রি হচ্ছে না। সারাবছর উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে যথাসময়ে ব্যাংক ঋণও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। আর যথাসময়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পরার কারণে প্রতিদিন ব্যাংকগুলোর কাছে চিনিকলগুলোর দায় বাড়তে থাকে। পঞ্চম কারণ—সরকারি চিনিকলগুলোয় প্রধান কাঁচামাল আখ চাষে চাষিদের আগ্রহ কমে গেছে।

মিলগুলোয় আখ সরবরাহ করতে সরকারি দলের আধিপত্য বিস্তার, সরকারি কর্মকর্তাদের নানা রকমের ঝুটঝামেলা এবং কলগুলোয় সরবরাহকৃত আখের মূল্য সময়মতো না পাওয়ায় আখচাষিরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ফলে সারাবছর মিল চালু রাখতে প্রয়োজনীয় আখ পাওয়া যায় না। সারাবছর আখ পাওয়া না যাওয়ায় বছরের প্রায় ৯ মাসই মিলগুলো বন্ধ রাখতে হয়। এ কারণে লোকসান বাড়ে। আর ৬ষ্ঠ কারণ—আখ সরবরাহে জটিলতা, আখের দাম পাওয়া যাওয়ায় আখ চাষের বদলে চাষিরা অন্য ফসল চাষ করার দিকে ঝুঁকছেন।

এ কারণে দিনদিন আখ চাষের জমি কমে যাচ্ছে। এটিও চিনিকলগুলোর লোকসানের অন্যতম কারণ। জানা গেছে, আখ উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে আখ চাষিদের মিলের মাধ্যমে যে ঋণ দেওয়া হয়, কৃষকরা সেই ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করলেও মিল কর্তৃপক্ষ পুরো টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করে না।

প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের শনাক্ত করা এই ৬ কারণের বাইরেও সরকারি চিনিকলগুলোয় লোকসান দেয়। তা হলো রাজনৈতিক প্রভাবে অধিক জনবল নিয়োগ। সিবিএ’র নামে দলাদলি। মিল পরিচালনায় সিবিএ নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং সিবিএ নেতার পরিচয়ে অধিক সংখ্যক জনবল মিলের উৎপাদন কাজে যুক্ত না হওয়া।

সরকারি মিলগুলোয় কাঁচামাল বা উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য যানবাহন মিলের কর্মকর্তা বা সিবিএ নেতা কর্তৃক ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের বিল আদায়। উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করণে কোনও বিপণন সিস্টেম না থাকা। মিলগুলোর লোকসানের আরেকটি কারণ পণ্যের প্রচার না থাকা।

পাশাপাশি বেসরকারি চিনিকলগুলোয় সিবিএ-এর দৌরাত্ম্য নেই। যে কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবলও নেই। সিবিএ না থাকার কারণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর কারও হস্তক্ষেপ নেই। বেসরকারি চিনিকলে কাজ না করে বেতন নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

বেসরকারি চিনিকলগুলো যেহেতু রিফাইনারি কারখানা, সেহেতু ওখানে কাঁচামালের অভাবে কারখানা বন্ধ থাকে না। সারাবছরই মিলগুলো চালু থাকে। ফলে লোকসান গুনতে হয় না। মুনাফা করে। তবে সরকারি চিনিকলগুলো সরকারি যে পৃষ্ঠপোষকতা পায়, বেসরকারি চিনিকলগুলো তা পায় না। তারপরও অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে সরকারি চিনিকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে।

সরকারি চিনিকলের লোকসানের বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, চিনি কলগুলো মান্ধাতার আমলের। এসব কলে উৎপাদন ক্ষমতা কম। এর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সে কারণে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ ছাড়া আখের সরবরাহ কম, উৎপাদন খরচ বেশি, বছরের অধিকাংশ সময় মিলগুলোর বন্ধ থাকা—ইত্যাদি কারণে চিনিকলগুলো লোকসানে চলছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, চিনিকলগুলোয় শুধু চিনি উৎপাদন করে লাভজনক করা যাবে না। চিনিকলের কর্মচারীদের বছরে মাত্র ৩ মাস কাজ থাকে। বাকি ৯ মাস তারা অলস সময় কাটান। আখমাড়াই মৌসুম শেষ হলে চিনিকলগুলোয় অন্য পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। অতিরিক্ত জনবল কমাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সেতাবগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সিনিয়র সহ-সভাপতি আজিজুর রহমান মল্লিক বলেন, শ্রমিক ইউনিয়নের কোনও নেতা কাজ না করে বসে বসে বেতন নেন, এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা নিয়ম মেনে কাজ করি এবং অন্য ১০ জনের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে ‘সপ্তা’নেই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনবল নিয়োগে আমাদের কোনও হাত নেই। আমরা কোনও জনবল নিয়োগ দেইনা, নিয়োগ দেয় মিল কর্তৃপক্ষ।

বিএসএফআইসির হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে এর পরিমাণ ১৮ থেকে ১৯ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে সরকারি ১৫টি চিনিকলে উৎপাদিত হয় মাত্র ২ লাখ২০ হাজার টনের মতো। আগামী দিনে দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। ফলে দেশে চিনির আমদানি আরও বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি সুগার রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন মোনেম জানিয়েছেন, সরকারি সব নিয়ম-কানুন মেনে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অধিক হারে সুদ পরিশোধ করে ব্যবসা করি। করপোরেট ট্যাক্স দেই। তারপর ব্যবসা করা খুবই কঠিন। কোনও রকমে টিকে আছি বৈকি।

এক প্রশ্নের জবাবে ফ্রেশ ব্র্যান্ডের চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, শ্রমিকদের পছন্দসই বেতন ভাতাসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা দেই। আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী র’সুগার আমদানি করি। এরপর ভ্যাট-ট্যাক্স তো আছেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসান নানাভাবে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেসরকারি চিনিকলগুলোয় চিনি পরিশোধন করা হয়। উৎপাদন নয়। ওই কলগুলোর র-সুগার আমদানি করা হয় বলে সারাবছরই মিলগুলো চালু রাখা যায়।

সরকারি চিনিকলগুলো আখের অভাবে সারাবছর চালু রাখা যায় না। তিনি বলেন, দেশি চিনি জনপ্রিয় করার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আখের চিনির গুণাগুণ জানাতে বিজ্ঞাপনসহ নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন