আইপিওতে আসা ২১ কোম্পানির দাম ইস্যু মূল্যের নিচে
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী জিবিবি পাওয়ারের ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারে আরও ৩০ টাকা প্রিমিয়াম অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রতিষ্ঠানটি ৪০ টাকার প্রতিটি শেয়ার নিয়ে বাজারে আসে ২০১৩ সালে। আর সোমবার শেয়ারটি বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭ টাকায়। গত ২ বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল মাত্র ৩২ টাকা। তাহলে প্রশ্ন উঠে বিএসইসির মূল্যায়ন কি সঠিক ছিল?
নিয়ম অনুযায়ী ইস্যু মূল্যে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা লাভ করবেন। কিন্তু এখন এ প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন কয়েক হাজার বিনিয়োগকারী। এভাবে বতর্মান কমিশন গঠনের পর এ পর্যন্ত ৩৫টি কোম্পানিকে প্রিমিয়াম দিয়ে বাজারে আসার অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে ২১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের অনেক নিচে নেমে এসেছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারই ইস্যু মূল্যের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন, তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিএসইসি এভাবে গণহারে নতুন নতুন কোম্পানিকে বাজারে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে? কমিশনের নির্ধারিত মূল্যে বিনিয়োগ করে কেন বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব হতে হবে? তাদের দাবি, বিএসইসি এবং বিভিন্ন কোম্পানির যোগসাজশেই নামসর্বস্ব দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি বাজারে এসে বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা করার সুযোগ নিচ্ছে।
বিএসইসি এসব কোম্পানির আর্থিক তথ্যকে অতি মূল্যায়িত করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, তারা প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করেই নতুন কোম্পানিকে বাজারে আসার অনুমোদন দিচ্ছে। বাজারে কোনো অনিয়ম পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে কমিশন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোম্পানির মৌলভিত্তি উপেক্ষা করে আইপিওতে (প্রাথমিক শেয়ার) উচ্চ প্রিমিয়াম দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। আর উচ্চমূল্যের আইপিও শেয়ারের ফলে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বতর্মান কমিশন গঠনের পর ৩৫টি কোম্পানিকে প্রিমিয়াম দিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়। বর্তমানে এর ২১টি কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া অনুমোদন দেয়া প্রায় কোম্পানিই আইপিও টাকা দিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে।
উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যাংক ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছে। এর অর্থ হল পুঁজিবাজারের টাকা মুদ্রাবাজারে স্থানান্তর হয়েছে। কিন্তু শিল্পের সম্প্রসারণ হয়নি। সেকেন্ডারি মার্কেটে কোম্পানি তালিকাভুক্তির পর প্রথম দু-এক দিন দাম কয়েকগুণ বাড়লেও এরপর কমতে শুরু করে। অন্যদিকে বেশ কিছু কোম্পানি তালিকাভুক্তির পর আয়ও কমে যাচ্ছে। গত ৫ বছরে অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তাদের মতে, উচ্চ প্রিমিয়ামের জন্য দায়ী বিএসইসি এবং কোম্পানির ম্যানেজার। তবে বিএসইসি বলছে তারা যাচাই করে প্রিমিয়াম দিচ্ছে।
ইস্যু মূল্যের নিচে শেয়ারের দাম : শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে বিএসইসির কাজ তিনটি- এর মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা বাড়ানো এবং সিকিউরিটিজ আইন ও কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়ানো। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বারবারই এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশের আলোকে ২০১১ সালের বিএসইসি পুনর্গঠন হয়। কিন্তু অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি।
দুর্বল কোম্পানিকে আইপিওতে উচ্চ প্রিমিয়াম অব্যাহত রয়েছে। গত ৫ বছরে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে. তার সবগুলোর অভিহিত মূল্য ১০ টাকা। কিন্তু এর কোনো কোম্পানিকে ৫০ টাকা পর্যন্ত প্রিমিয়াম দেয়া হয়েছে। ১০ টাকার শেয়ারের সঙ্গে আরও ৩০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে ৪০ টাকায় অনুমোদন দেয়া হয় জিবিবি পাওয়ার। সোমবার প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ১৭ টাকায় নেমে এসেছে। এ হিসাবে আইপিওতে যে বিনিয়োগকারী শেয়ার পেয়েছে, তারও ২৩ টাকা লোকসান হয়েছে। এছাড়া ৮ টাকা প্রিমিয়ামসহ রংপুর ডেইরির ইস্যু ছিল ১৮ টাকা। কিন্তু সোমবার তা ১৬ টাকায় নেমে এসেছে। জাহিন টেক্সটাইলের ২৫ ইস্যু মূল্যের শেয়ার সোমবার ২৩ টাকায় নেমেছে।
এছাড়া বরকত উল্লাহ ইলেক্ট্রো ডাইনামিকের ৬০ টাকার শেয়ার ২৯ টাকা, ইউনিক হোটেলের ৭৫ টাকার শেয়ার ৪৯, সায়হাম কটনের ২০ টাকার শেয়ার ১৫, জিএসপি ফাইন্যান্সের ২৫ টাকার শেয়ার ১৪ টাকা, হামিদ ফেব্রিকসের ৩৫ টাকার শেয়ার ১৭ টাকা, ওয়েস্টার্ন মেরিনের ৩৫ টাকার শেয়ার ২৩ টাকা, ফারইস্ট নিটিংয়ের ২৭ টাকার শেয়ার ১৬ টাকা, পেনিনসুলার ৩০ টাকার শেয়ার ১৬ টাকা, শাশা ডেনিমসের ৩৫ টাকার শেয়ার ৩৪ টাকা, তরসিফা ইন্ডাস্ট্রিজের ২৬ টাকার শেয়ার ১৭ টাকা, সিমটেক্সে ২০ টাকার শেয়ার ১৯ টাকা এবং রিজেন্ট টেক্সটাইলের ২৫ টাকার শেয়ার ২০ টাকায় নেমে এসেছে।
শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে : ২০১২ সালে ১০ টাকার শেয়ারে আরও ৫০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬০ টাকায় বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ওরিয়ন ফার্মা। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ছিল ৬ টাকা ০২ পয়সা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে তা কমে ৪ টাকা ০৬ পয়সায় নেমে এসেছে। ২০১১ সালে বাজারে আসে আমরা টেকনোলজি। ওই বছর কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা। কিন্তু ২০১২-তে ২ টাকা ৪৬ পয়সায় নেমে আসে। ২০০৭ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১৪ টাকা ১৯ পয়সা। পরের বছর নেমে আসে ১০ টাকা ৫৫ পয়সায়। আর্গন ডেনিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ২০১১ সালের ৫ টাকা ৪৬ পয়সার ইপিএস ২০১২ সালে নেমে এসেছে ৪ টাকা ৫১ পয়সায়।
ব্যাংক ঋণ পরিশোধ : গত ৫ বছরে প্রায় সবগুলো কোম্পাানিই আইপিওর টাকা দিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হামিদ ফেব্রিকস, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস, সুরিদ ইন্ডাস্ট্রিজ, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, তুইং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং, হোটেল পেনিনসুলা চট্টগ্রাম, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফ্যামিলি টেক্স, অ্যাপোলো ইস্পাত, ওরিয়ন ফার্মা, বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মো প্লাস্টিক, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, জেনারেশন নেক্সট, আর্গন ডেনিম, সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার, আমরা টেকনোলজি, ইউনিক হোটেল এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল।
মূল্য কারসাজি : বাজারে তালিকাভুক্তির পর প্রথম দিন শেয়ারের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও এরপর মূল্যপতন শুরু হয়। গত ৫ বছরে একই চিত্র বারবার দেখা গেছে। এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারী পরিকল্পিতভাবে আইপিওর মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রিমিয়ামকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে বাজারে আইপিও নিয়ে এক ধরনের খেলা চলে। তালিকাভুক্তির দিন এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেকের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৫৫০ শতাংশ। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন টানা দরপতনের শিকার হয় কোম্পানিটি। তিন দিনের মাথায় বিনিয়োগকারীদের অনেক লোকসান গুনতে হয়েছে। একই ঘটনা ঘটে মোজাফফর স্পিনিং মিলস ও অ্যাপোলো ইস্পাতের ক্ষেত্রেও।
শুরুর দিকে দুটি কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা হয় ৪২ থেকে ৪৩ টাকায়। কিন্তু পরে মূল্য কমে যায়। বর্তমানে অ্যাপোলো ইস্পাতের শেয়ার ১৯ টাকা পর্যন্ত নেমে আসে। তালিকাভুক্তির পরপরই কোম্পানির ইপিএস কমতে থাকে। একই ঘটনা আমরা টেকনোলজিস, আরগন ডেনিমস, সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যালসের মতো কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও। বিশ্লেষকদের মতে, কোম্পানির তালিকাভুক্তির দিন বাজারে এক ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতও থাকে। আবার কোনো কোনো সময় একটি গ্র“প তৈরি হয়ে যায়, যারা পরিকল্পিতভাবে এসব শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। দুই ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীর পকেট।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত : এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ ব্যাংক ঋণ শোধের পর কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অবশ্যই ভালো হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ঋণ শোধ হলে তার দায় কমে। এতে মুনাফা বাড়ে। কিন্তু আয় কমলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে তালিকাভুক্তির বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা উচিত। কারণ এসব কোম্পানি অতিমূল্যায়িত হয়ে তালিকাভুক্ত হলে বাজারে প্রভাব পড়ে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিনিয়োগকারীদেরও দেখেশুনে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, আইপিও অনুমোদন জরুরি। তবে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু ব্যাংক ঋণ পরিশোধে আইপিও না দিতে আমাদের পক্ষ থেকে বিএসইসির কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি তারা আমলে নেয়নি। তিনি বলেন, যেসব কোম্পানি ব্যাংক ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর শোধ করতে পারছে না সেগুলোই শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।