পুঁজিবাজারে তিন মাসে ৫১ হাজার কোটি টাকা উধাও!
পুঁজিবাজার টানা দরপতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে সাধারন বিনিয়োগকারীরা। তারা বাজারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। গত কয়েক মাস ধরে অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতিতে বাজারবিমুখ হতে শুরু করছে বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান এই বাজারে খরা কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ছে না। পুঁজিবাজারে ২০১০ সালে মহাধ্বসের পর বাজার বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বাজার স্থিতিশীলতার আশ্বাস দিলেও বাজারচিত্র দেখাচ্ছে উল্টো চিত্র। নতুন করে প্রবেশ করা অর্থ বাদ দিলে বাজার মূলধন থেকে উধাও হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
এ সময়ে অনেক বিনিয়োগকারী ফের হতাশায় বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। তবে বাজারের এমন করুণ অবস্থায়ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। আর এ অবস্থার জন্য বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের তীর সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিকে। ধারাবাহিক পতনে সূচক লেনদেনের পাশাপাশি হ্রাস পেয়েছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সম্মিলিত বাজার মূলধন হারিয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা।
চলমান এ পরিস্থিতিতে পুঁজি হারিয়ে আবারো পথে বসতে চলেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এছাড়াও ব্যাংকের এক্সপ্রোজাল লিমিট বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় দরপতনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করছে বিনিয়োগকারীরা।
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিস্কিয়তা, বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, আইসিবি, মার্চেন্ট ব্যাংক, উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নীরব ভূমিকায় আবারও ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছে পুঁজিবাজার।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে বাজারের এমন অবস্থা। নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অহরহ মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে কারসাজি করছে। একইসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ কমছে। পুঁজিবাজারে নগদ টাকার সঙ্কট বেড়েছে। মন্ধা বাজারে এক শ্রেণীর কারসাজিকারকরা বাজারা নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী মাহামুদুল আলম বলেন, পুঁজিবাজার একটা স্পর্শকাতর বাজার। দেশে যেকোনো ঘটনা ঘটলেই তা পুঁজিবাজারের ওপর প্রভাব ফেলে। দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অভাব, স্থায়ী বিনিয়োগ না হওয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণ নীরব ও নিস্কিয় থাকার কারণে লেনদেন ও বাজার মূলধন কমেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসই ও সিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৩ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এসময় দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সম্মিলিত ৫১ হাজার ৬৫১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বাজার মূলধন কমেছে। এর মধ্যে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কমেছে ২৬ হাজার ৩৩৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) হারিয়েছে ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ৫ আগস্ট ডিএসইর বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিলো ৩ লাখ ৪০ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। যা তিন মাসের ব্যবধানে ২৬ হাজার ৩৩৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা কমে ৫ নভেম্বর নেমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকায়।
এদিকে, আলোচিত সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স চার হাজার ৮৭৩ থেকে ৩৭১ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৫০২ পয়েন্টে অব্স্থান করছে। দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে ৫ আগস্ট বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ৭২ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। ৫ নভেম্বর তা নেমে এসেছে দুই লাখ ৪৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকায়। এদিকে আলোচিত সময়ে সিএসইর সার্বিক মূল্য সূচক সিএসইএক্স ৯ হাজার ১০৩ পয়েন্ট থেকে ৭৩৬ পয়েন্ট কমে ৮ হাজার ৩৬৭ পয়েন্টে অব্স্থান করছে।
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন করণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও প্রায় নিস্কিয় রয়েছে। ফলে সূচকের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে কমছে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর। নতুন করে বিনিয়োগকারী আসছে না। আবার যারা বাজারে আছে তারাও আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই বাজার মূলধনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাজারে কারসাজির জন্য একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে উল্লেখ করে মির্জা আজিজুল বলেন, বর্তমানে পারিপার্শ্বিক এমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি যে ধারাবাহিকভাবে দরপতন হবে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে খতিয়ে দেখতে হবে।
বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিশোধের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত বাজারে লোকসান দিচ্ছি। বাজার থেকে দিন দিন কোটি কোটি টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এতে করে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।