সাম্প্রতিক পুঁজিবাজার দরপতনের পেছনে আট কাহিনী
নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদাসীনতায় পুঁজিবাজার ভারসাম্যহীন ভাবে চলছে। বাজার তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। ফলে বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। এ পরিস্থিতির মধ্যে পাঁচ বছর অতিক্রম করছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা বর্তমান বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এছাড়া বর্তমানে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার। বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে সূচক।
সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজারের মূলধন। গত ১৯ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে। এছাড়া একই সময়ে ১৬৩ কোটি টাকার লেনদেন কমার পাশাপাশি বাজারের সূচক কমেছে ২০৫ পয়েন্টেরও বেশি। বিষয়টি যেমন সাধারণ
বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার-সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারণে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছাড়া বাকিগুলো পুরোপুরি নিস্কিয় ভূমিকা পালন করছে।
পোর্টফোলিও ম্যানেজারসহ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বর্তমানে সাইডলাইনে থেকে বাজার পর্যবেক্ষণে বেশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া ও বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী।
এছাড়া রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত অনেকে মার্জিন লোন নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না কোনো কোনো বিনিয়োগকারী। পরিণতিতে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের এই অস্বাভাবিক পতনের কয়েকটি কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণফোনসহ বড় কোম্পানিগুলো থেকে বিদেশীরা বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারি সংস্থাগুলো পুঁজিবাজারে অভিযান শুরু করেছে। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংক তাদের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় করছে।
পুঁজিবাজারে প্রভাবশালীদের কয়েকটি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১২ দেশের নতুন অর্থনৈতিক জোট ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রফতানিমুখী যে সব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তাদের আয় কমতে পারে।
ডিএসই’র বাজার বিশ্লেষনে দেখা যায়, গত মাসের ২২ তারিখে (২২ সেপ্টেম্বর) বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩১ কোটি ৩১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। সর্বশেষ কার্যদিবসে (২১ অক্টোবর ’১৫) তা ৩ লাখ ২২ হাজার ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসেবে মাত্র ১৯ কার্যদিবসের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে মূলধন কমেছে ১৫ হাজার ৭২৯ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এদিকে, গত ২০ কার্যদিবসের ব্যবধানে বাজারে লেনদেন কমেছে ১৬৩ কোটি টাকারও বেশি।
অর্থাৎ গত ২১ সেপ্টেম্বর বাজারে ৫০৯ কোটি টাকার লেনদেন হলেও সর্বশেষ কার্যদিবসে অর্থাৎ গতকাল তা ৩৫৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসেবে বাজারে ২০ কার্যদিবসে লেনদেন কমেছে ১৬৩ কোটি ৪৬ লাখ টাক।
মূল্যসূচক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২২ সেপ্টেম্বর ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৪৮৫৩.২৯ পয়েন্টে অবস্থান করলেও গতকাল তা ৪৬৪৭.৬৭ পয়েন্টে নেমে এসেছে। সেই হিসেবে আগের মাসের একই সময়ের ব্যবধানে সূচক কমেছে ২০৫ পয়েন্টেরও বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে চলে যাচ্ছে। তাতে বাজারে একটি বিক্রির চাপ তৈরি হয়েছে। শেয়ারবাজার নিয়ে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সরকারি সংস্থাগুলো তার উল্টো কাজ করছে।
কিছু দিন পর পর দুদক শেয়ারবাজারে তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি পাঠায়। এছাড়া বর্তমানে কোনো বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়। ফলে বাজারে একটি ভীতি কাজ করছে। যে কারণে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছে না।
তাছাড়া দেশের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। বিদেশী নাগরিক হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর নিয়ে দেশ অস্থির হওয়ার আশংকা রয়েছে। ফলে সচেতন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে সাইট লাইনে চলে যাচ্ছে।
আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, সার্বিক পরিস্থতিতে পুঁজিবাজার কিছুটা অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। গ্রামীণফোন, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট এবং মবিল যমুনার মতো বড় মূলধনী কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম টানা কমছে। এতে অন্য কোম্পানিগুলোরও দর পতন হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিবির একজন কর্মকর্তা জানান, বাজারে বড় স্টেক হোল্ডার গ্রামীণফোন। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে প্রতিষ্ঠানটির ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আর ৬ মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয় ১০ কোটি টাকা কমেছে। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে।
ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ : শেয়ারবাজারে বর্তমানে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ সমন্বয়ের সর্বশেষ সীমা ২০১৬ সালের ২১ জুন। এ কারণে ব্যাংকগুলো চাপে শেয়ার বিক্রি করছে। ফলে সমন্বয়ের মেয়াদ না বাড়লে শেয়ারবাজার আরও খারাপ হবে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই সীমা আরও ৪ বছর বাড়াতে ডিএসই এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ছিল মোট দায়ের ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো এই সীমা অতিক্রম করে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে বিনিয়োগ কমিয়ে আনা হলে শেয়ারবাজারে বিপর্যয় হয়। এরপর ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকের বিনিয়োগ ইক্যুইটির ২৫ শতাংশ করা হয়।
আর ইক্যুইটির মধ্যে রয়েছে পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ রিজার্ভ এবং অবণ্টিত মুনাফা। এতে আগে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা ১ হাজার কোটি টাকা থাকলে বর্তমানে তা ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। আর অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের মেয়াদ ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়। এ কারণে বিনিয়োগ সমন্বয়ে ব্যাংকগুলো চাপে রয়েছে। প্রতিদিনই ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) করতে হচ্ছে।
পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পতনের কারণটি স্পষ্ট নয়। হঠাৎ করে দরপতনের মতো পারিপার্শ্বিক কোনো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি।
তবে দেশের বিনিয়োগকারীরা এখনও হুজগে শেয়ার বেচাকেনা করে। এছাড়া বাজারে কারসাজির জন্য একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে খতিয়ে দেখতে হবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের দরপতন অপ্রত্যাশিত। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি এখানে অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জাপানি ও ইতালির নাগরিকের হত্যার কারণে বাজারে প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া বিদেশী ক্রেতারাও পোশাক খাতের অর্ডার বাতিল করছে। বিষয়টি নেতিবাচক। তবে তিনি মনে করেন আইসিবিসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাপোর্ট দিলে বাজার এই অবস্থায় টিকে থাকতে পারে।
অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী এ্যাড. মাহামুদুল আলম বলেন, পুঁজিবাজারে স্মরনকালের ভয়াবহ ধসের রেশ এখনো কাটেনি। এ মহাধসের পাঁচ বছর অতিবাহিত হতে চললেও বিনিযোগকারীরা অনেকে এখনো লোকসানে আছে। ফলে এ রকম অন্ধকার পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করে নতুন করে কেউ লোকসানে যেতে চাইবে না। তারা আরো জানান, সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন।
তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় শুধু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাজার পর্যবেক্ষণে কমিটি গঠন করলেই হবে না। বরং এসব পদক্ষেপ ও নীতিমালা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করা একান্ত দরকার।
শহিদুল ইসলাম, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম