অনিয়মের আখড়া রিজেন্ট টেক্সটাইল পর্ব-২
আলী ইব্রাহিম: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্তির জন্য প্রাথমিক গণ প্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন পেয়েছে টেক্সটাইল খাতের কোম্পানি রিজেন্ট টেক্সটাইল। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানি আইনকে তোয়াক্বা না করেই চলছে। পুজিবাজারের র্সাবিক এ অবস্থায় এসব কোম্পানি তালিকাভুক্তি কতটা যৌক্তিক বলে প্রশ্ন ওঠেছে।
কোম্পানিটি বছরের পর বছর ব্যবসা করেছে কোন ডিভিডেন্ড দেয়নি। অথচ পুজিবাজারে তালিকাভুক্তিকে সামনে রেখে নামমাত্র ডিভিডেন্ড ঘোষনা করেছে। মূলত বাজার থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য এমন মুনাফার উস্ফলন দেখানো হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা এত আগ্রহী হয়ে বিনিয়োগ করেন।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝা যায় কোম্পানির আসল হাল হকিকত। কোম্পানির অতিরিক্ত মুনাফা দেখায় তালিকাভুক্তিতে কোন বাধা না আসে সেজন্য। যেসব কোম্পানি অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে আসছে তাদের দু-তিন বছরের মধ্যে আসল অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান বাজারে এসব কোম্পানির অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশী যাচাই করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ সাজানো হয়েছে পারিবারিকভাবে। এতে রয়েছেন ভাই ভাতিজারা যা কোম্পানি সুশাসনের সুস্পষ্ট লংঘন। কোম্পানির চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলীর ভাই ইয়াছিন আলী রয়েছেন পরিচালক পদে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন ইয়াছিন আলীর ছেলে সালমান হাবিব। ইয়াকুব আলীর দুই ছেলে পরিচালনা পর্ষদে আছেন। স্বতন্ত্র পরিচালক পদেও রয়েছেন জাবেদ ইকবাল যার বয়স ৩৩ বছর আর অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে ১৪ বছর। যা দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সাতে অসামঞ্জস্য পূর্ণ।
এছাড়া তার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিবিএ করেছেন তার নাম কোথাও উল্ল্যেখ নেই। এতেও তাদের পারিবারিক ঘরনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া একই ব্যক্তি একাধিক কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সম্প্রতি আইপিওতে অনুমোদন প্রাপ্ত রিজেন্ট টেক্সটাইলে একাধিক কোম্পানিতে একই দায়িত্ব পালন করছেন। যা কোম্পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কোম্পানির পরিচালক ইয়াসিন আলী কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরন্স এবং মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
আইনানুযায়ী, একই সময়ে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকা যাবে না। তাই আইনের তোয়াক্কা না করেই পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানির এ পরিচালক। কিন্তু ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো পাবলিক ও পাবলিকের অধীনস্ত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এমন ব্যক্তিকে পরিচালক পদে নিয়োগ দেবে না, যদি তিনি অন্ততপক্ষে অপর কোনো একটি কোম্পানিতে এমডি বা পরিচালিক পদে নিযুক্ত থাকেন।’
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যেকোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনসহ দেশে বিদ্যমান সকল আইনের পরিপালন বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারাও অন্যতম একটি। কারণ এ বিষয়ে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
এরপরও কোম্পানিটি আইনের লঙ্ঘন করে কীভাবে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন পেয়েছেÑ তা কারোরই বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিএসইসির ভূমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, একটি কোম্পানিকে অর্থ সংগ্রহের অনুমতি দেয়ার আগে কোম্পানিটি দেশের বিদ্যমান আইন শতভাগ পরিপালন করেছে কি-না তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব বিএসইসির।
এ প্রসঙ্গে বিএসইসির কমিশনার আরিফ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘একই ব্যক্তি একাধিক কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন না এটা কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসির কোনো নীতিমালা নেই। তবে যেকোনো কোম্পানিকে আইপিওতে অনুমোদন দেয়ার আগে কোম্পানিটি বিদ্যমান সকল আইন পরিপালন করছে কি নাÑ তা খতিয়ে দেখা হয়।
এক্ষেত্রে কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে বিএসইসি এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় দলিলাদি জমা দিতে বলে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যদি সরকারের কাছে আবেদন করে থাকে, আর সরকারও যদি তার অনুমোদন দেয় তবে কোম্পানিগুলো তা জমা দিয়ে দেয়।’ এক্ষেত্রে বিএসইসির কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই বলে জানান তিনি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আইনি দুর্বলতার কারণেই কোম্পানিগুলো নিয়মের মধ্যে থেকে অনিয়ম করে যাচ্ছে। কারণ কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারায় সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে একই ব্যক্তি একাধিক কোম্পানিতে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ কোম্পানিই সে সুযোগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা অবৈধ অর্থ আদান-প্রদানের মাধ্যমে লবিং করে অনুমতি নিয়ে নিচ্ছে।
এখন কথা হলো- যদি তাদেরকে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে একাধিক কোম্পানিতে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে একই আইনে আবার নিষেধাজ্ঞা কেন? তিনি বলেন, যদি অনিয়ম ও দুর্নীতিকেই রোধ করা এ আইনের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। তা না হলে এ ধরনের অনিয়ম যুগে যুগে চলতেই থাকবে।
তবে যেহেতু পুঁজিবাজারে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ রয়েছে, তাই সাধারণ জনগণ তথা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি বিএসইসির ওপরই বর্তায়। সেজন্য এ বিষয়গুলোতে বিএসইসিকে আরো সচেতন হতে হবে। রিজেন্ট টেক্সটাইল কোম্পানি প্রায় পুরোটাই একই পরিবারের মালিকাধীন। ইয়াসিন আলী এবং ইয়াকুব আলী দুই ভাই এবং তাদের সন্তানদের মালিকানায় রয়েছে প্রায় পুরো কোম্পানিই।
আর পরিচালনা পর্ষদেও রয়েছে শুধুমাত্র এ পরিবারের সদস্যরা। এদিকে পারিবারিক মালিকানায় পরিচালিত হবার কারণে কোম্পানিতে নেই কোনো কর্পোরেট গভর্নেন্স। ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে আলী পরিবারের তিন সদস্যই নবীন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাকি তিন পরিচালকের বয়স যথাক্রমে ২৬, ৩০ এবং ২৪। নবীন এসব পরিচালকের ব্যবসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিয়ে তাই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।