পুঁজিবাজারে উদ্যোগ আছে কিন্তু বাস্তবায়নের গতি নেই, আস্থা সংকটে বিনিয়োগকারীরা
শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরেই ওঠানামার মধ্য দিয়ে চলছে। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বাজার সংশ্লিষ্টরা বাজারকে চাঙা করতে নানা পদক্ষেপ নিলেও, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি আসছে না। ফলে পুঁজিবাজারে গতি এসেও আসছে না। এছাড়া বাজার আজ ভালো তো কাল খারাপ। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন পার করছে।
তবে টেকসই পুঁজিবাজার গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগে মাঝে মধ্যে চাঙাভাব থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় কাটছে পুঁজিবাজার। ফলে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের কিছুটা ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা দেখা দিলেও দ্বিতীয় কার্যদিবসে ফের দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা।
তেমনি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছে না। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। যার ফলে লেনদেন এখন আর হাজার কোটি টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। তেমনি পুঁজিবাজারে পতন থামানোর কোন উদ্যোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার না থাকায় হতাশা বিরাজ করছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাজার নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। সূচকের কাজই উঠানামা করা। তবে অস্থিরতা পুঁজিবাজারে নিয়মিত বিষয়। স্বল্পমেয়াদী পতন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করে। কারণ বাজারে এখনও সম্ভাবনাময় সেক্টরগুলো বিনিয়োগকারীর আগ্রহ ধরে রেখেছে এবং কিছু শেয়ারে ইতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কাজী হোসাইন আলী বলছেন, বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের দাবী জানিয়ে আসছি। তবে দীর্ঘ ১৫ বছরও একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার ফিরে পায়নি। এ কারণে প্রতিদিনই বাজারে নিস্কিয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে। লোকসান কমাতে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকে। তাতে একদিকে কমছে শেয়ারের দাম অন্যদিকে লেনদেনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেখানে অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পুঁজিবাজার একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেখানে আমাদের দেশে পুঁজিবাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান আর পুঁজিবাজার কাঙ্খিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে গতি আনার জন্য শুধু স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও দরকার জানিয়ে বলেন, বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনরুদ্ধার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, তারল্য বাড়ানো এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট, তারল্য সংকট, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়া, সঠিক প্রণোদনার অভাব, নীতি ও বিধিনিষেধে অনিশ্চয়তার কারণে পুঁজিবাজারে গতি এসেও আসছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিএসইসি কর্তৃক গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য মো. আল-আমিন বলেছেন, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতোই ব্যবহার করা হয়।
অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে পুঁজিবাজারকে নেগলেক্ট করে রাখা হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়ভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা (আমলা) নিজেদের অবস্থান ছাড়তে চান না। ফলে পুঁজিবাজারে নেগলেকশন চলছে এবং তারা এখান থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা নিচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে টেকসই ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার মূল কারণ গভর্নেন্স ব্যর্থতা। এজন্য অডিটর, ভ্যালুয়েশন ফার্ম ও স্বাধীন পরিচালকদের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ‘ফিট অ্যান্ড প্রপার’ তালিকা প্রণয়ন করে যোগ্য ও অভিজ্ঞ পরিচালকদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এসব পদক্ষেপ ছাড়া বিনিয়োগকারীর আস্থা ও বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে গতি আনতে নতুন ও সম্ভাবনাময় কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করলে বাজারে গতি বাড়বে। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করলে পুঁজিবাজারে স্থায়ী গতি ফিরতে পারে। এছাড়া কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও। এরই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও টানা ঊর্ধ্বধারায় ছিল না।
জানা গেছে, সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। তবে টাকার পরিমানে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ২৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৪২৩ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৭১ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ২ হাজার ৮৮ পয়েন্টে।
দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯৫ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৯৬ টির, দর কমেছে ২৫৫ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৪ টির। ডিএসইতে ৭৩৬ কোটি ৮১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ১১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বেশি। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৬১৯ কোটি ২৮ লাখ টাকার ।
অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৯০ পয়েন্টে। সিএসইতে ২০০ টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে ৭৬ টির দর বেড়েছে, কমেছে ১০০টির এবং ২৪ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।

