শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে লেনদেন একেবারেই তলানিতে নেমে এসেছে, সূচক পড়ছেই। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে গেছে। সবার মাঝে অজানা আতঙ্ক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আস্থা পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। উল্টো অনেকে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েও বাজার ছাড়ছেন।

কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজার সংস্কারের নামে টালবাহানা করছেন। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে চলছে টানা দরপতনের মাতম। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের বড় দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর ও টাকার পরিমানে লেনদেন। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা যে বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন, তার প্রমাণ মেলে বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্যে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের ১৪ কার্যদিবসে সাড়ে ৬ হাজার বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। তাতে এসব বিও হিসাব এখন শেয়ারশূন্য বিও হিসাবে পরিণত হয়েছে।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলেন, এটা পুঁজিবাজার নয়, যেন মরন বাজার। এখনো বিনিয়োগ করলে মৃত্যু নিশ্চিত। আমরা এমন পুঁজিবাজার চাই না। এছাড়া বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংস্কারের নামে বিনিয়োগকারীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। টানা দরপতন হলেও বিএসইসি বলছে সংস্কার চলছে। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন এ কেমন সংস্কার। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নি:স্ব হওয়ার পথে। অথচ বাজার স্থিতিশীল করার জন্য বিএসইসি এখন পর্যন্ত কোন কার্যকরী পদক্ষেপ চেখে পড়ছে না।

এছাড়া টানা দরপতনে বাড়ছে ফোর্স সেল। এ অবস্থায় ফোর্স সেল বন্ধ না করলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবো না। তাছাড়া এভাবে চলতে থাকলে মানুষ পুঁজিবাজার থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফলে বিএসইসির চেয়ারম্যান শুধু বড় বড় কথাই বলে যাচ্ছেন, কাজের কাজ কিছুই করতে পারছে না। সে কারণেই বিনিয়োগকারীরা এখন সব হারিয়ে পথে বসেছেন।

বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বাজার এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। তাতে অনেক শেয়ার বিনিয়োগযোগ্য অবস্থায় চলে এসেছে। আমরা আশা করছি, এখন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হলে বাজার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান কমিশনের উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের কারনে নতুন করে বাজারমুখী হচ্ছে না। এছাড়া বাজারে এ মুহূর্তে অর্থের চেয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটই বেশি। এ কারণে বিও হিসাবে টাকা থাকার পরও অনেকে শেয়ার ক্রয় করছেন না। আবার অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু টাকা তুলে নিচ্ছেন না। শেয়ার বিক্রির পরও বিনিয়োগকারীদের টাকা বিও হিসাবে অলস পড়ে থাকছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে, এই বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগ করা নিয়ে আস্থাহীনতায় ভুগছেন।

আস্থাহীনতার কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, পুনর্গঠিত বিএসইসির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সবই সংস্কারকে কেন্দ্র করে। এসব পদক্ষেপের সুফল হয়তো পাওয়া যাবে দীর্ঘ মেয়াদে। কিন্তু বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদি কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান নয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নিস্কিয়। অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারীও খুব বেশি আসছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও খুব বেশি সক্রিয় নেই। পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের একটি বড় অংশই ব্যাংকের বিনিয়োগ। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিনিয়োগ।

প্রাতিষ্ঠানিক এসব বিনিয়োগকারীর মধ্যে ব্যাংকের কাছ থেকে বর্তমানে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। বাজারে যেসব মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ নিস্কিয়। আইসিবির বিনিয়োগের মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই। এর বাইরে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগও সীমিত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বাজারে বিক্রেতা বেশি। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি হওয়ায় দরপতন চলছে।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাজারে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছে। তাই বাজারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু রাতারাতি ও এককভাবে কারও পক্ষে বাজার থেকে সব অনিয়ম দূর করা কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজই করতে হবে বাজারসংশ্লিষ্ট সবপক্ষকে আস্থায় নিয়ে, ধীরে ধীরে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজারসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্দেশ্য খারাপ না হলেও তারা নিজেদের পুরোপুরি বাজারবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ কারণে হয়তো কিছুটা আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৫৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ১১৪ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৪৪ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ১৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮৭৯ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯৫ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৮৩ টির, দর কমেছে ২৭২ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৪০ টির।

ডিএসইতে ৩০৬ কোটি ১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ১৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩২১ কোটি ৯৯ লাখ টাকার ।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৯৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৩০২ পয়েন্টে। সিএসইতে ১৮৪ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৯ টির দর বেড়েছে, কমেছে ১৩০ টির এবং ১৫ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।